বাতাসে পোড়া লাশগুলোর গন্ধ। কাঁদছেন নিহতদের স্বজনরা। বাবা খুঁজছেন একমাত্র ছেলেকে, স্বামীর ছবি বুকে নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে আর্তনাদ-আহাজারি করছেন স্ত্রী। তাদের চোখের জল আর সুগন্ধা নদীর পানি মিলেমিশে একাকার। এসবই এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তী দৃশ্য। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য ছুঁয়ে গেছে সারাদেশের মানুষকে। সবার মনেই প্রশ্ন- আসলে কীভাবে আগুন লাগে? কতজন যাত্রী ছিলেন পুড়ে যাওয়া লঞ্চে?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের লাইসেন্সের মেয়াদও চলতি বছরের শুরুতেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এরপরও মালিকপক্ষ দেদারসে যাত্রী পরিবহন করে আসছিল। ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় লঞ্চটি ২৫জন স্টাফসহ ৩১০ জনের ভয়েস ক্লিয়ারেন্স দিয়ে টার্মিনাল ত্যাগ করে। দিনে লঞ্চটির ধারণ ক্ষমতা ৭৬০ জন হলেও রাতের তা কমিয়ে ৪২০ জন করা হয়েছে।যাত্রীদের অভিযোগ- ঘাট ছাড়ার সময়ই যাত্রীতে পরিপূর্ণ ছিল লঞ্চটি। চাঁদপুর ঘাটে থামার পর সেখান থেকে এত যাত্রী ওঠেন যে- লঞ্চে তিল ধারণেরও ঠাই ছিল না।
যাত্রীসংখ্যা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল সূত্র বলছে, অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন সবমিলিয়ে ৪০ জন। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৭২ জন ও ঝালকাঠিতে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮০ জন। এদিকে, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে- ৯০০ জন ধারণক্ষমতার লঞ্চটিতে ৩১০ জন যাত্রী ভ্রমণ করছিলেন। অন্যদিকে, বেঁচে ফেরা যাত্রীরা জানিয়েছেন- লঞ্চটিতে যাত্রী ছিলো এক হাজারের বেশি।
জ্বলছে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে বিভ্রান্তি
আগুন লাগা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। লঞ্চের কর্মীদের বক্তব্য- ইঞ্জিনরুমের পাশেই ক্যানটিনে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগেছে। আবার যাত্রীরা বলছেন- ইঞ্জিনরুম থেকে আগুনের সূত্রপাত, ছাড়ার সময় থেকেই লঞ্চের ডেক গরম ছিল। পরে সেখানে কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কার করে কিছু না বললেও ইঞ্জিনরুম থেকেই আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড ও জেলা প্রশাসন। এদিকে ঘটনার পর থেকে লঞ্চের একজন স্টাফকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার সময় বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগে। ঐ সময় কেবিন ও ডেকের বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। হতাহতের সংখ্যা কোনোরকমে জানা গেলেও কতজন যাত্রী তীব্র শীতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠে প্রাণ বাঁচিয়েছেন তার কোনো হদিস নেই।
যাত্রীরা দিলেন বেঁচে ফেরার রোমহর্ষক বর্ণনা
বেচেঁ যাওয়া যাত্রী বামনা উপজেলার মো. আবদুল্লাহ জানান, আগুন দেখে নিচতলার ডেকের যাত্রীরা দোতলায় অবস্থান নেন। লঞ্চের স্টাফরা কেবিনের যাত্রীদের কেবিন থেকে বের হতে নিষেধ করেন। আগুন লাগার প্রায় ৩০-৪০ মিনিট পর লঞ্চটি প্রথমে বিষখালী-সুগন্ধ্যা-ধানসিড়ি নদীর মোহনায় থামানো হয়। সেখানে লঞ্চের স্টাফসহ অনেক যাত্রী নেমে যেতে সক্ষম হন। তবে আটকা পড়েন কেবিন ও ডেকে ঘুমন্ত যাত্রীরা। সেখান থেকে লঞ্চটি ভাসতে ভাসতে ঝালকাঠির দিয়াকুল গ্রামে সুগন্ধ্যা নদীর তীরে আটকে যায়। সেখানে বেশ কিছু যাত্রীকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা। আবার অনেকে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়েন।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জ্বলন্ত লঞ্চ থেকে মাঝ নদীতে ঝাঁপ দেন বরগুনার রাজু আহমেদ
আহত যাত্রী রাসেল মিয়া বলেন, আগুন লাগার পর লঞ্চের চালক চাইলে অনেক আগেই থামাতে পারতেন। আগুন লাগার পর তিনি লঞ্চটি অনেকক্ষণ চালিয়েছেন। পরে যাত্রীদের মৃত্যুর মুখে ফেলে চালকসহ লঞ্চের সব স্টাফ পালিয়ে গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, ভোর ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ নদীর তীর থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। লাশ উদ্ধার করে ঝালকাঠি পৌর মিনি পার্কে রাখা হয়। সেখানে সুরতহাল তৈরির পর পাঠানো হয় মর্গে। ফায়ার সার্ভিস দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
লঞ্চে আগুনের খবর পেয়ে বরগুনা ও আশপাশের এলাকা থেকে যাত্রীদের স্বজনরা ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকায় আসেন। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে ঐ এলাকার আকাশ-বাতাস। বরগুনার মো. হারুন জানান, তার মেয়ে রিমু বেগম ও নাতি লিমা নিখোঁজ। একই এলাকার আল-আমিন জানান, তার বড় ভাই ইদ্রিস নিখোঁজ। ফোরকান জানান, তার বোন রিনা, ভাগনি নুসরাতের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হতাহতদের চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
তদন্ত কমিটি ও আর্থিক সহায়তা
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে শুক্রবার বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, র্যাব ডিজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাদল, ডিআইজি আক্তারুজ্জামানসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানান, উদ্ধারকৃত ৩৬ লাশের মধ্যে পাঁচজন শনাক্ত হয়েছে। পোস্টমর্টেম শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে।
তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ও। নিহতদের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এভাবে আগুন লেগে পুরো লঞ্চ ভস্মিভূত হওয়ার পেছনে কোনো রহস্য থাকতে পারে। এমন ঘটনা দেশে আগে ঘটেনি। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হবে।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের দগ্ধ যাত্রীদের
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের দগ্ধ যাত্রীদের
দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. এসএম আইউব হোসেন। জানান, বরিশাল মেডিকেলে ভর্তি দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৬ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকেই বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। এ দলে রয়েছেন- শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাশরুর রহমান আবির ও ডা. নুর আলম, রেজিস্ট্রার ডা. মোরশেদ কামাল, ডা. মৃদুল কান্তি সাহা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ডা. ইশতিয়াক ও ডা. মুনতাসির।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেছেন, হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স এবং স্টাফের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জরুরি বিভাগে সব রোগীকে ফ্রি টিকেটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ, স্যালাইন, অক্সিজেন, বালিশ, বিছানা, কম্বল সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্লাড ডোনেশন ক্লাবগুলোকে রক্ত সরবরাহের জন্য বলা হয়েছে।