বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় এক একর জমি ভরাট করে রীতিমতো পাথরের ব্যবসা করছেন ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী মোহাম্মদ সেলিম। পাথর মজুদ ও ওঠানামার সুবিধার্থে কেরানীগঞ্জ থানার মধ্যেরচর মৌজায় ৮টি সীমানা পিলার থেকে নদীর ভেতরে কয়েকশ’ গজ পর্যন্ত ভরাট করা হয়েছে।
নদী দখল ও ভরাটের অভিযোগে মদিনা মেরিটাইমে গত দুই বছরে কয়েক দফায় অভিযান চালানো হয়। মদিনা মেরিটাইম হল- হাজী মোহাম্মদ সেলিমের মালিকানাধীন মদিনা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযানে সেখান থেকে কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরে মামলা দায়ের করে পুলিশ। পাশাপাশি তীরভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত এই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তবুও ক্ষমতার জোরে নদীর পাড়ে পাথর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে মদিনা মেরিটাইম।
শুধু তাই নয়, দখল করা জায়গায় ওয়াচ টাওয়ারসহ বিভিন্ন স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি ভরাট করা জমিতে লাগানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড। যেখানে লেখা আছে- ‘ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক মদিনা মেরিটাইম লি.র পক্ষে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম। তিনি হাজী সেলিমের ছেলে ও মদিনা গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। যদিও এসব জমি কেনা বলে দাবি করছে মদিনা গ্রুপের কর্মকর্তারা।
সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বৈধ ও অবৈধভাবে কে কে নদী ও নদীর জমি ব্যবহার করছে তা দেখভালের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর। সংস্থাটিকে এসব বিষয় কঠোরভাবে দেখভালের নির্দেশনা দেয়া আছে। তারাই বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, বুড়িগঙ্গার পাড়ে যেখানে পাথর ব্যবসা চলছে সেখানে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। নদী দখলের দায়ে কয়েকজনকে আটকও করা হয়। আবারও নদী দখলের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নদীর পাড়ে ২২ শতাংশ তীরভূমি ব্যবহারের জন্য মদিনা মেরিটাইমকে ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর লাইসেন্স দেয় বিআইডব্লিউটিএ। শর্ত অনুযায়ী, ওই জায়গায় ১২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট ভাসমান বার্জ থাকবে। বার্জের ওপর ১৪০ বর্গফুটের কনভেয়ার বেল্ট ও ৩২০ বর্গফুটের ক্রেন স্থাপন করে জাহাজ থেকে পাথর, কয়লা, ভুট্টা ও অন্যান্য সমজাতীয় পণ্য খালাস করতে পারবে। নদী ভরাট ও অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ না করাসহ কয়েকটি শর্ত দেয়া হয় লাইসেন্সে। কিন্তু ওই লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে গেছে।
নদী ভরাট ও শর্ত ভঙ্গের দায়ে ওই লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। আর পরবর্তীকালে আবেদন করা হলেও সেটি নবায়ন করেনি বিআইডব্লিউটিএ। বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বছিলা ব্রিজের দুই কিলোমিটার ভাটিতে কেরানীগঞ্জের মধ্যেরচর মৌজায় ঝাউচর খেয়াঘাট থেকে কমবেশি ৩০০ গজ দূরে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থিত মদিনা মেরিটাইম কোম্পানির পাথর ব্যবসা কেন্দ্র।
লাইসেন্স স্থগিত থাকলেও পুরোদমে পাথর ব্যবসা করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নিজের নামের কিছু জমিসহ নদীর ভরাট করা স্থানে পাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে। প্রবেশ গেট ও ভেতরে ওয়াচ টাওয়ারে প্রহরীরা কড়া পাহারা দিচ্ছেন।
অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এই প্রতিবেদকের নাম গোপন রেখে কৌশলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেছে, দেয়ালের ভেতরে রয়েছে নদীর ৮টি সীমানা পিলার (সরকার নির্ধারিত)। সেই পিলারগুলো থেকে কয়েকশ’ ফুট পর্যন্ত নদী ভরাট করা হয়েছে। এতে নদীর অন্তত এক একর জমি এ প্রতিষ্ঠানটির দখলে চলে গেছে। এছাড়া এক প্রান্তে সম্প্রতি নদী ভরাট করার আলামতও পাওয়া গেছে। সেখানে ইট ও বালু ফেলানো হয়েছে।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, ওই সীমানার ভেতর কয়েক হাজার টন পাথর স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পাথর লোড-আনলোড করার জন্য কয়েকটি ট্রাক ও ভেকু মেশিনও রয়েছে। তবে কোনো বার্জ বা কনভেয়ার বেল্ট সেখানে দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, নদীর পাড়ে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের নামে অন্তত ২০টি সাইনবোর্ড লাগানো আছে। এতে লেখা রয়েছে, মদিনা মেরিটাইম লিমিটেডের পক্ষে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের নামে কেনা হয়েছে। আরও কয়েকটি সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য মজুদ অবস্থায় দেখা গেছে। এছাড়া সেখানে একটি ফিলিং স্টেশনও রয়েছে। ওই ফিলিং স্টেশন থেকে মদিনা গ্রুপের গাড়িতে তেল দেয়া হচ্ছে। নদীর পাড়ে জাহাজ নির্মাণের অবশিষ্টাংশ দেখা গেছে।
নদী দখল ও পাথর ব্যবসা নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দেয়ার পরই বাড়িতে হামলার শঙ্কা রয়েছে। এর আগেও এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএতে অভিযোগ করে কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। উল্টো অভিযোগকারীদের হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। তবে ওই স্থাপনার পাশে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা স্থানীয় বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, তিন বছর ধরে পাথর ব্যবসা শুরু হয়েছে। পাথর লোড-আনলোড করেছে। এখানে জাহাজও বানিয়েছে। তিনি বলেন, কিছু জমি কিনেছে, অনেকের জমি কেনার কথা বলে নিয়ে নিছে। যতই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, তার কাজ সেই করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মো. বেলাল মদিনা গ্রুপের ডিজিএম (ভূমি ক্রয়) নুরুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। জানতে চাইলে নুরুল হামিদ বলেন, নদীর সীমানা পিলার বসানোর আগে এসব জমি কেনা হয়েছে। জমির খাজনা ও নামজারি করা হয়েছে। নদী দখলের প্রশ্নই আসে না।
আর বিআইডব্লিউটিএ নদীর জমির মালিক নয়। তারা নদীর তীরভূমি ব্যবহারের লাইসেন্স দেয়। আমরা লাইসেন্স নিয়েছি। মেয়াদ শেষ হয়েছে। নবায়নের আবেদন করতে বিলম্ব হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় বাসিন্দা ইব্রাহিম বেপারির (করোনা আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি মারা গেছেন) মাধ্যমে এসব জমি কেনা হয়েছে। নদীর জমি ভরাট করা হয়নি। ভরাট করার প্রমাণ দিতে পারলে খনন করে দেব। নদী ভরাটের দায়ে মদিনা গ্রুপের কয়েকজনকে গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, পাথর সংক্রান্ত অন্য বিষয়ে গ্রেফতার করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএর সদ্য বিদায়ী ঢাকা নদী বন্দর কর্মকর্তা একেএম আরিফ উদ্দীন বলেন, ঢাকা নদী বন্দর কর্মকর্তার পদে থাকাবস্থায় নদী দখল ও ভরাটের ঘটনায় কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি। সর্বশেষ গত মে মাসে অভিযান চালিয়ে মদিনা গ্রুপের কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরেছে পুলিশ। ভরাটের কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি ডাম্প ট্রাকও জব্দ করা হয়।
এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলাও দায়ের করা হয়েছে। লাইসেন্সের শর্ত না মানায় নবায়ন স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, যে ইব্রাহিম বেপারির মাধ্যমে জমি কেনার কথা বলা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেও ২০১৯ সালে নদীর জমি বিক্রি এবং ভরাট করে সংকুচিত করার অপরাধে মামলা করা হয়। ওই মামলায় ইব্রাহিমের পাঁচজন সহযোগীকে আসামি করা হয়।
অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি স্থানীয় বাসিন্দারা : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহাজ থেকে পাথর নামিয়ে সড়ক পথে পরিবহন করায় স্থানীয়দের সমস্যার কথা জানিয়ে গত ২৪ জুন বিআইডব্লিউটিএতে আবেদন করেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা। তারা নদী দখল করে রাখা পাথরের স্তূপের ছবিও দেন।
ওই ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) মো. সাইফুল ইসলাম ও ল্যান্ড সেলের ট্রেসার মো. আবদুল হাইকে দিয়ে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে নদী দখলের কোনো চিত্রই তুলে আনেননি কমিটির সদস্যরা। এমনকি যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলোর সত্যতা পাননি বলে উল্লেখ করেন প্রতিবেদনে। এমনটি শর্ত ভঙ্গ করে পাথর লোড বা আনলোডের কোনো তথ্যই প্রতিবেদনে নিয়ে আসেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নদীর জমি দখল করে আছে। সেখানে অবৈধভাবে জাহাজ নির্মাণ করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা যখন গেছেন তখনও নদীর সীমানা পিলারের ভেতরের পাথর রাখার স্তূপ ছিল। তবুও রহস্যজনক কারণে তারা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিদর্শনের সময়ে আমি যা দেখেছি, তাই উল্লেখ করেছি। যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিদর্শনে সীমানা পিলার থেকে নদীর দিকে কিছু অংশে পাথর স্তূপ করা ছিল। তাদের কেনা জমিতেও পাথর ছিল।