করোনা যখন দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সংহার করে অসহায় করে ফেলছে, তখন কিছু সুবিধাভোগী বরাবরের মতো করোনাকেই সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে। করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে তা বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে।
এ যেন ঘর পোড়ার মধ্যেই আলু পোড়া! সাধারণ মানুষ আশা করেছিল করোনার মতো মহাদুর্যোগে অন্তত সবাই মানবিক আচরণের চেষ্টা করবে।
কিন্তু বাস্তবে তা লক্ষ করা গেল না। প্রথম ধাক্কায় পাঁচ টাকা দামের মাস্ক ৫০-৬০ টাকা হয়ে গেল। কোথাও তা আরও চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছে। ৫০-৬০ টাকা দামের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ৩০০-৩৫০ টাকা হয়ে গেল। তাও আবার বাজারে অপ্রতুল। সবই ছিল কৃত্রিম সংকট।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা করোনা শুরুর পর বিশেষভাবে স্পষ্ট হল। দেখা গেল অনেক হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা নেই, আবার থাকলেও কোনো কোনো হাসপাতালে তা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। করোনা রোগীর জন্য অত্যাবশ্যক অক্সিজেন সংকট এবং চড়া দামে তা বিক্রির খবরও পাওয়া গেছে।
মানুষ যখন দুর্যোগে পতিত হয় তখন এমনিতেই তার মন ও শরীর দুর্বল থাকে। করোনাকালের প্রথম ধাপে আমাদের অবস্থা সেরূপই ছিল। এ অবস্থার সুযোগে কোনো কোনো অসাধু ব্যবসায়ীর আচরণে আমরা বিস্মিত হয়েছি। কেউ কেউ রোগী বহনের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া হেঁকেছে তিন-চারগুণ।
করোনায় বহির্বিশ্বে ১০০ কোটি টাকার পিপিইর বাজার তৈরি হলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে মানবিক দিক বিবেচনায় সেগুলো সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়নি। সার্জিক্যাল মাস্ক, গগলস, কোভিড নমুনা সংগ্রহ বুথ, বডিব্যাগ, স্লিজ গার্ড ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া লক্ষ করা গেল, নিম্নমানের পণ্যে বাজার সয়লাব। করোনা পরীক্ষায় কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক সরকার নির্ধারিত চার্জের চেয়ে বেশি নিয়েছে। এছাড়া ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে।
করোনা মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে বেশ কিছু হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করে বিভিন্ন ব্যক্তির পোয়াবারো হয়েছে- নিম্নমানের পণ্য দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে ক্রয় আদেশ দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে।
একটি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জরুরি ভিত্তিতে দশগুণ দামে আত্মীয়ের কাছে পণ্য ক্রয়ের কার্যাদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু পণ্য বুঝিয়ে দেয়ার আগেই বিল মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশে কোনো কোনো দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিগতভাবে মুনাফা করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে নিজেই ঠকে।
করোনাকালে আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তিটি আমাদের দেশের জন্য প্রণিধানযোগ্য হতে পারে- ‘মন্দ লোকের মন্দ কাজে দুনিয়া ধ্বংস হয় না, ধ্বংস হয় অন্য লোকরা চুপ করে থাকে বলে’। অনেক সাধারণ মানুষ এমনিতেই নানা রকম সমস্যায় দিনযাপন করছে। করোনার ভয়াবহতায় মুনাফাখোরদের কাছে তারা আরও বেশি জিম্মি রয়েছে।
অবস্থা যত ভয়াবহই হোক, মানুষকে খেয়ে বাঁচতে হয়, মুনাফাখোররা তা ভালোভাবেই জানে। তাই পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ থাকার পরও নিত্য ভোগ্যপণ্যের কোনো কোনো কারবারি করোনাকালের সুযোগ নিতে এতটুকু পিছপা হচ্ছে না। নিখুঁত ছক করে তারা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে চলছে।
করোনাকালে সরকারের পক্ষ থেকে নানারকম ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। নানা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে নগদ ও খাদ্য সহায়তা প্রদানের উদ্যোগের বিষয়টিও উল্লেখ করার মতো।
কিন্তু সর্ষেতে ভূত যে সবখানে। তৃণমূল পর্যায়ে বিতরণ কার্যক্রমে কোনো কোনো ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার মওকা পেয়ে গেল। সরকার ইতিমধ্যে তূণমূলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে। প্রশ্ন হল, বিতরণ কার্যক্রমে কাক্সিক্ষত স্বচ্ছতা আসবে কি?
চীনে করোনার উৎপত্তি হলেও চীনের অর্থনীতিতে আবার তেজিভাব দেখা দিয়েছে। চীন করোনাকালেও বিশ্বের উৎপাদনের মোট ৫০ শতাংশ মাস্ক উৎপাদন করেছে এবং সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা সামগ্রী রফতানি করেছে। আর আমাদের দেশে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮২ লাখ মানুষের একটা বড় অংশ করোনাকালে পেশাচ্যুত হয়ে এখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত আছে। শুধু তাই নয়, করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ে আইএমএফের রিপোর্টে বিশ্বে ৩৪ কোটি মানুষ কাজ হারানোর যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, সে তালিকায়ও বাংলাদেশ প্রথম দিকে রয়েছে।
করোনায় দেশের কেবল রফতানি খাতের সার্বিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ শতাংশ। এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কেবল দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল আবশ্যক। সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ যেটুকুই থাকছে- অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি সমগ্র শুভ উদ্যোগকে নস্যাৎ করতে পারে। দেশে ফন্দি-ফিকির করা মানুষ সংখ্যায় কম হলেও তাদের প্রতাপ কম নয়।
তাদের কাছে সাধারণ মানুষ বড়ই অসহায়। সরকারের চলমান বাজেটের প্রাক্কলনও হয়েছে করোনার বিবেচনায়। এটি ইতিবাচক। প্রশ্ন হল, দেশে হলমার্কের মতো আরও কত প্রতিষ্ঠান আছে?
দেশে ইদানীং একটি কালচার দাঁড়িয়ে গেছে, ছোটোখাটো বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। অথচ যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নিলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করত না। করোনাকালে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যতটা আন্তরিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে, নিম্ন ধাপের দফতরগুলোতে তা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
করোনার দুর্দিনের পর শিগগির সুদিন আসবে, সবাই সেই সুদিনের প্রত্যাশায় রয়েছি। প্রশ্ন হল, যখন করোনার ভয়াবহতা থাকবে না, তখন আমরা কি ভুলতে পারব তাদের কথা, যারা করোনাকে পুঁজি করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে চলছে?
খান মাহবুব : প্রাবন্ধিক ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়