ডলারের সংকটে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় শঙ্কা বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেদারসে ডলার বিক্রি। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমায় বেশিরভাগ ব্যাংকে তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার ভয়াবহ সংকট। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক পারছে না আমদানির দায় পরিশোধ করতে। এদিকে স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরের মাত্র ১৩৩ দিনে ৫৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের মাত্র চার মাস পেরোতেই ডলার বিক্রিতে রেকর্ড গড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎকালে কখনোই এত ডলার বিক্রি করতে হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংককে। এ সময়ে ৫৫৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করে মুদ্রাবাজারকে সহযোগিতা করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। এর আগের পুরো অর্থবছরে ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি হয়। এ ছাড়া গত অর্থবছরের একই সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ১০৯ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। প্রতি ডলার ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করা হয়। এতে করে চলতি অর্থবছরে ডলার বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াল মোট ৫৫৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। এতে করে রিজার্ভ কমে দাঁড়াল ৩৪ দশমিক ২৬ বা তিন হাজার ৪২৬ কোটি ডলারে। যদিও নিট রিজার্ভ এর চেয়ে আট বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার কম। এ হিসাবে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬২৬ কোটি ডলার।
অন্যদিকে ডলার বিক্রিতে চলতি বছর বেশ কয়েকটি রেকর্ড হয়েছে এবং সামনে আরও হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইতিমধ্যেই ডলার বিক্রি সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। এতে করে আগের বছরের রেকর্ড যে ভেঙে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুন করে ডলার বিক্রির রেকর্ড কত হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা যাচ্ছে তা ১০ বিলিয়নের আশেপাশে থাকবে।’
চলতি অর্থবছরের ২৯ আগস্ট এক দিনে ডলার বিক্রির নতুন রেকর্ড গড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দিন ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ১৬৪ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এত রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রিতে নিয়মিতভাবে ডলারের রিজার্ভ কমতে থাকে। গেল অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। চলতি অর্থবছরে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রিতে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে।
রিজার্ভের পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে রফতানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি ও প্রবাসী আয় দুটোই বাড়ে। এতে করে আশার আলো জ্বলে ওঠে রিজার্ভের সংকটে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে বড়সড় আঘাত লাগে প্রবাসী আয়ে। এ ছাড়া রফতানি আয়ে প্রাক্কলিত পরিমাণের চেয়ে কম হয় ২৬ কোটি ডলার। জুলাই ও আগস্টে ৪১২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে, যা পরবর্তী দুই মাসে কমে দাঁড়ায় ৩০৬ কোটি ডলারে। এতে করে আবার হুমকিতে পড়ে রিজার্ভের অঙ্ক।
চলতি মাসেও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমার শঙ্কায় আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও রেমিট্যান্স বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বাফেদা রেমিট্যান্স পাঠাতে চার্জ বা অতিরিক্ত অর্থ আর না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া সাপ্তাহিক বন্ধের দিনগুলোতে ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক শাখা খোলা রাখবে বলেও জানায় সংগঠনটি।
এসব সিদ্ধান্তে রেমিট্যান্স আসার হার আবার বাড়বে বলে মনে করেন বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম।
তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের কষ্টার্জিত টাকা বৈধ চ্যানেলে আনার। তাদের যেন কোনো হয়রানি না করা হয় এবং সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে তাদের রেমিট্যান্স আনতে আমরা উদ্যোগী হয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছি। আশা করি প্রবাসী ভাইয়েরা দেশের উন্নয়নে আগের মতো অবদান রাখবে এবং এতে করে দেশের অর্থনীতি প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হবে।’
এসব সিদ্ধান্ত খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না রেমিট্যান্সের গতি ফেরাতে বলে মন্তব্য করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
ব্র্যাক ব্যাংকের এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘ডলার রেট বেঁধে রেখে রেমিট্যান্স বাড়ানো সম্ভব না। একদিকে আপনি ডলারের দর কমিয়ে দেবেন আর ওদিকে খোলা বাজারে ডলারের দাম বেশি হবে, তাহলে তো গ্রাহক আপনার কাছে যাবে না। যাবে খোলা বাজারে। রেমিট্যান্সের গতি ফেরাতে খোলা বাজার ও ব্যাংকে ডলারের রেট কাছাকাছি হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ ২০০ ডলার পাঠায় দেশে তবে ব্যাংকে দিলে সে পাবে ২১ হাজার ৪০০ টাকা, সঙ্গে আরও ২০০ টাকা প্রণোদনা। কিন্তু হুন্ডিতে পাঠালে সে পাবে ২২ হাজার ৫০০ টাকা। এত ব্যবধান থাকলে কখনোই ব্যাংকিং চ্যানেলে গতি ফিরবে না। এ ব্যবধান কমাতে হবে।’
নবচেতনা /আতিক