দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কতটা স্বাধীন কিংবা এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে বিদ্যমান দুর্নীতি দমনে কতটা সফল- এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের মেয়াদকালে গত সাড়ে চার বছরে দুর্নীতি নির্মূলে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, তিনি কোন ধরনের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন এবং কোথায় ব্যর্থ ও কেন-তাও জানতে চান সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে টিআইবির পক্ষ থেকেও এ ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে।
ছয় মাস পরই শেষ হচ্ছে দুদক চেয়ারম্যানের পাঁচ বছর চুক্তির মেয়াদ। এ দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকালে তার সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে জানতে চাইলে ইকবাল মাহমুদ বলেন, কমিশন কতটুকু করতে পেরেছে তা দৃশ্যমান। চেষ্টা করেছি কমিশনকে একটি শক্ত জায়গায় নিতে। আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। দুদক এখন আগের জায়গায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুদকের নাম শুনলে দুর্নীতিবাজের বুকে একটু হলেও ঝাঁকুনি দেয়। এমন অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, যারা ভেবেছিলেন কিছুই হবে না। অনেকের হাতে হাতকড়া পড়েছে।
বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়া বা আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। ব্যাংকের টাকা এমনভাবে লেয়ারিং হয়েছে যার জন্য অর্থের পূর্ণাঙ্গ গতিবিধি শনাক্ত করতে বিলম্ব হচ্ছে। দুদকের তদন্তকালে বেসিক ব্যাংকের লোপাট হওয়া টাকার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি নগদ ক্যাশ আদায় হয়েছে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের উত্তরে ইকবাল মাহমুদ অর্থ পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের আইনি সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানুষের প্রত্যাশা পূরণে দুদকের ঘাটতি রয়েছে। ছোট ও মধ্য পর্যায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও উচ্চপর্যায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে দুদক উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ কারণে দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে। প্রকারান্তরে উচ্চপর্যায়ের লোকজনকে সুরক্ষা দিয়েছে।
এদিকে দুদকের বিগত সাড়ে চার বছরের কাজ ও পদক্ষেপগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এফবিআই, সিবিআইয়ের আদলে গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিজ প্রসিকিউশন ও তদন্তের বিষয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। তিন ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেয়া ৪০ জন কর্মকর্তা দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট, তথ্যপ্রযুক্তি ইউনিট ও বিশেষ অনুসন্ধান-তদন্ত ইউনিটে বিশেষ দায়িত্ব পালন করছেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের প্রশিক্ষণ নেন দুদকের পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার তিন ডজন কর্মকর্তা। তাদেরও বিশেষ অনুসন্ধানের কাজ দেয়া হয়েছে।
সক্ষমতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে আইন ও বিধি সংশোধন করে থানায় না গিয়ে নিজস্ব কার্যালয়ে মামলা করার ক্ষমতা পায় দুদক। সংস্থাটির গোয়েন্দা বিভাগের কার্যক্রম কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়। সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের গতিবিধি অনুসরণে তথ্যপ্রযুক্তি ও কল রেকর্ডের জন্য নিজস্ব সার্ভার স্থাপন করে দুদক। মন্ত্রণালয় ও সরকারি সেবা দফতরে দুর্নীতি রোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সরকারের কাছে সুপারিশ তুলে ধরা হয়। যেসব সংস্থা দুদকের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি, তা উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া দেশের মানুষের কাছ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণের জন্য সংস্থাটি একটি বিশেষ হটলাইন (১০৬) চালু করে। হটলাইনে ২০১৯ সালেই ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫২৪টি ফোন কল পায় দুদক। এর মাধ্যমে ১ হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এজন্য দুদক একটি এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ’র সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদানে চুক্তি করে সংস্থাটি। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী মহাপরিচালক থেকে উপসহকারী পরিচালক পর্যন্ত অনুসন্ধান ও তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে চেষ্টা ছিল পুরো সময়জুড়ে। এক ডজন এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে মামলাও করেছে তারা। বড় বিষয় ছিল এসব কাজ বাস্তবায়নে কমিশনারদের মাঝে বড় ধরনের কোনো মতবিরোধ ছিল না। ইকবাল মাহমুদ ছাড়াও কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান ও এএফএম আমিনুল ইসলাম দুদকের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বিশেষ নজর দেন। তারা মনে করেন, একটি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হলে তার কার্যক্রমও শক্ত হয়। কমিশন সে কাজটিই করেছে।
এসব সফলতার পাশাপাশি দুদকের ব্যর্থতার দিকও রয়েছে। অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে বেসিক ব্যাংকের তদন্ত শেষ করতে না পারা, পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে না পারা, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, কানাডার বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়াসহ পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারেনি দুদক। গেল সময়ে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও দুদক ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। অনেক প্রভাবশালীর অনুরোধ উপেক্ষা করে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ অব্যাহত রেখেছে। বেশ কয়েকজন এমপিকে দুদকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। বেশ কয়েকজন আমলা, তিনজন ডিআইজিসহ উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনীতিকও দুদকের জালে আটকা পড়েছেন।
বেসরকারি পর্যায়ের কোনো প্রভাবশালীর অর্থ পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদককে অনেক হিসাব করে হাত দিতে হয়। কারণ দুদক আইনে কেবল সরকারি পদে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ বিদেশে অর্থ পাচার করলে তাকেই আটঘাট বেঁধে ধরা যায়। ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের তদন্তভার বিএফআইইউসহ অন্য কয়েকটি সংস্থাকে দেয়া হয়। বাদ পড়ে দুদক। এই আইনি সীমাবদ্ধতার মাঝেও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের অর্থ পাচারের তদন্তে দুদককে একটি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেছে। তা হল- যারা বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত, তাদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে টান দেয়া। দুদক মনে করে, বৈধ কোনো অর্থ অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাচার হয় না। ফলে এক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনায় দুদক বেশ সফলতাও পায়। স্বাস্থ্যের কর্মচারী আবজাল হাজার কোটি টাকার মালিক। দুদকের রিমান্ডে স্বীকার করেছেন দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। এমন আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে। তা নিয়ে কাজ চলছে। দুদকের তদন্তের মুখে পড়ে আর্থিক খাতের অর্থ লোপাটকারী প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) দেশে ফিরে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নেয়া অর্থ উদ্ধারে সাহায়তা করতে চায়। দুদক জানায়, মামলার তদন্ত ও প্রাথমিক অনুসন্ধান চলাকালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ উদ্ধার হয়েছে। ২০১৯ সালেই ৪৩৬ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে। দুদকের মামলায় ৩ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা জরিমানাও হয়েছে। সাজার পরিমাণও আশিভাগ।
ইকবাল মাহমুদ ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার নেয়ার পর প্রথমেই প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত দিকটির প্রতি নজর দেন। দুদকের নেয়া সমন্বিত কৌশলপত্রে দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো যুগান্তকারী কৌশল গ্রহণ করা হয়। একই সঙ্গে দুদককে একটি শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে দাঁড় করাতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে কমিশন। সেই পরিকল্পনায় যেসব বিষয়কে প্রধান্য দেয়া হয়েছিল পর্যায়ক্রমে তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হয়। এফবিআই ও সিবিআইয়ের অনুসন্ধান কাজের সঙ্গে মিল রেখে দুদকে গঠন করা হয় পৃথক গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দা বিভাগের কাজ জেলা পর্যায়েও সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ পরিচালনা করছে। জেলা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা গোপন অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রধান কার্যালয়ে পাঠান। তালিকায় যাদের নাম আসে কমিশন যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মামলা দায়ের নয়, আসামিদের গ্রেফতার, দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ মামলায় সংশ্লিষ্ট অবৈধ সম্পদ জব্দ করার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে কমিশন। ইকবাল মাহমুদ যোগদানের প্রথম বছরেই বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৪০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমান কমিশনের সময়ে অন্তত এক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে দুদক। পিকে হালদারসহ পাঁচ শতাধিক আলোচিত ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করে দুদক।
দুদক একাধিক দেশের সঙ্গে দুর্নীতির তথ্য আদানপ্রদানে চুক্তিও করে। ভারত, রাশিয়া, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দুদক দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে। ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে প্রথম সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। দুদকে এফবিআই থেকে শুরু করে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট, ইউনাইটেড ন্যাশন্স অফিস অন ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইম, এডিবি, জিআইজেড, টিআই, জাইকা, অক্সফাম, ইউএনডিপির বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে দুদক টেকনিক্যাল সহযোগিতাও নিচ্ছে।