কিছু মানুষের পৃথিবীতে আগমন ঘটে মানুষকে কিছু দেবার জন্য। আজ এমনি একজন মমতাময়ী মায়ের কথা বলবো যার জীবনটাই দানে দানে অপরিমেয় হয়ে উঠেছে। দেশ ও মানব কল্যাণে নিবেদিত এই মানুষটি হলেন চট্টগ্রাম বিভাগের স্পেশাল পিপি,সাবেক এডিশনাল পিপি,বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও কলামিস্ট অধ্যাপক এডভোকেট কামরুন নাহার বেগম। আলোকিত এ মানুষটির সুনাম আইন আদালত ও মানবাধিকার অঙ্গনে সর্বজনবিদিত। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও মানসিক শক্তিত্বে বলিয়ান তিনি। চট্টগ্রামের অবহেলিত মানুষদের সেবা প্রদান,অধিকার আদায়ে সংগ্রাম ছাড়াও তিনি তাদেরকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করায়ও কাজ করে যাচ্ছেন সমানতালে। যার ধরুন তিনি বীর চট্টলার আলোকবর্তিকা হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত। বীর চট্টলার আলোকবর্তিকা অধ্যাপক এডভোকেট কামরুন নাহার বেগম মা হিসেবে নিজের সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলায়ও একটুখানি পিছিয়ে রননি। ৮ সন্তানের সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ঋদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত। স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বড় ছেলে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি। উচ্চশিক্ষিত মেজো ছেলে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মৎস্যখামারি। তৃতীয় ছেলে শিপিং ব্যবসায়ী। ৪র্থ ছেলে বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সেখানেই প্রতিষ্ঠিত। কনিষ্ঠ ছেলে আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যবসায়ী। তিন কন্যার একজন চিকিৎসক, মেজ মেয়ে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে এলএল.এম করে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বার-এটল তে অধ্যয়নরত। রত্নগর্ভা বলতে যা বোঝায়, সত্যিকার অর্থে তিনি তাই-ই।
এডভোকেট কামরুন নাহার বেগম ১৯৭০ সালে গভ: ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৬ বর্ষের শিক্ষার্থী। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বি এস এ এবং ১৯৮০ সালে বিএড কলেজ থেকে ১ম শ্রেণিতে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এলএল.বি ডিগ্রী লাভ করেন। পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি পদুয়া ডিগ্রী কলেজে বেশ কিছুদিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৮ সালে আইন পেশায় যোগ দেন। ঘরে বসে আয়েশি কিংবা ঘুরে বেড়িয়ে বিলাসী জীবন-যাপনের অবারিত দ্বার তাঁর সামনে। কিন্তু বৈষয়িক, জাগতিক এসব প্রাপ্তি, ভালো থাকা তাঁর খুব বেশি পছন্দ নয়। গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদেরকে আইনী সহায়তা প্রদান কিংবা মানবতা লঙ্ঘনের জায়গায় প্রতিবাদী ঝান্ডা হাতে লড়াই করার রক্ত যার শরীরে, দীক্ষা-শিক্ষা যে জীবনে; সে জীবনের কাছে লাভ-অলাভ, বিলাসব্যসন সবই তুচ্ছ, নস্যি। তিনি প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফিরেন আর্তপীড়িতের সেবায়, নারীর ক্ষমতায়নে। নারীদের অধিকার রক্ষায়,নারী শিক্ষার বিকাশে,নারীদেরকে সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করায়,তাদেরকে আত্ন নির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলায়,তাদের কর্মক্ষেত্র তৈরীতে এবং তাদেরকে তাদের অধিকারের বিষয়ে সজাগ করায় অসামান্য অবদান রাখায় অধ্যাপক এডভোকেট কামরুন নাহার বেগমকে নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয়।
অধ্যাপক এডভোকেট কামরুন নাহার বেগমের জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া থানাধীন খানমোহন গ্রামে। তাঁর বাবা মোহাম্মদ আবদুল মালেক, মা রাবেয়া খানম। তিনি রাঙ্গুনিয়ার কৃতিসন্তান খ্যাতিমান আইনজীবী আইন অঙ্গনের পুরোধা পুরুষ, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও দু’বারের জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আলহাজ্ব নুরুচ্ছফা তালুকদারের সহধর্মিণী। স্বামীর উৎসাহেই আইন পেশায় আসেন তিনি। প্যারালাইসিসের মতো রোগও তাঁকে কাবু করতে পারেনি। ১৭ বছর আগেই হারিয়েছেন চলৎশক্তি। হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়। কিন্তু এসব কিছুই এক মুহূর্তের জন্য তাঁকে দমাতে পারেনি। ঝড়-তুফান, বৃষ্টিবাদল যাই আসুক- প্রতিদিন তিনি নির্দিষ্ট সময়ে ছুটে যান আদালতে। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প শোনেন চেম্বারে বসে। জুনিয়রদের ইন্সট্রাকশন দিয়ে সাধ্যমত সমস্যাসঙ্কুল মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কখনো কখনো বিচারকের কক্ষে নিজেই ছোটেন গাউন পরে। ‘তাঁর রচিত ‘নারী, মানবাধিকার ও বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপট’, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ এবং ‘আমার দেখা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ এবং এশিয়া ও ইউরোপের ১৩ টি দেশ’ বই ৩টি পড়লেই তাঁর জ্ঞানের গভীরতা অনুভব করা যায়। মানবাধিকার কর্মকান্ডে বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি একাধিক পদক এবং সম্মাননাও লাভ করেন।
সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, নারী উন্নয়ন ও মানবাধিকারমূলক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ মানবাধিকার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। তিনি নারী অধিকার এবং সমাজে নারীদের মর্যাদা সম্পর্কে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লিখে থাকেন এবং বিভিন্ন সময়ে টিভি- রেডিওতে নারী নির্যাতন, নারীদের অধিকার ও নারীসুরক্ষা সম্পর্কে আইনগত বক্তব্য রেখেছেন। তিনি হিউম্যান রাইটস কমিশন চট্টগ্রাম ডিভিশনের প্রাক্তন ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলার হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি। তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা ইসলামী পাঠাগারের সদস্য, লেডিস ক্লাবের সদস্য, চট্টগ্রাম রোজ গার্ডেনের পি.পি,বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট চট্টগ্রামের সভাপতি। ছাত্রী অবস্থা থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সদস্য, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জাতীয় পেশাজীবী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। এ ছাড়াও এ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম একজন সফল মানবাধিকার কর্মী হিসেবে ২০০০ সালে মানবাধিকার কমিশনের জাতীয় সম্মেলনে ‘ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস’ পদকে ভূষিত হন।২০২১ সালে টেলিভিশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অব বাংলাদেশ (ট্রাব) প্রদত্ত ট্রাব স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী সম্মাননা অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। দুস্থ নারী ও মহিলাদের সহায়তা দানের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রে বায়োলজিকেল ইন্সটিটিউট ২০০৩ সালে তাঁকে ‘ওম্যান অব দ্যা ইয়ার’ মনোনীত করে। অধ্যাপক এ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে এশিয়া এবং ইউরোপ মহাদেশের ১৩টি দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন। পরিভ্রমণকালে তিনি সে সমস্ত দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও নানান বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। পরে তাঁর এই অভিজ্ঞতা নিজ দেশের বিশেষত চট্টগ্রামের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবাধিকার, নারী উন্নয়ন ও নানা বিষয়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন।
ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, লুঙেনবার্গ, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ অধ্যাপক এ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম সে দেশসমূহের রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সামাজিক অবস্থা সর্বোপরি সে দেশসমূহের আইন এবং বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরণ এবং উল্লিখিত দেশসমূহের ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং দর্শনীয় স্থানসমূহ স্বচক্ষে অবলোকন করে বাস্তব জ্ঞান আহরণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজ দেশের পাঠক সমাজের কাছে উল্লিখিত দেশসমূহের সঠিক অবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অনেক ত্যাগ রয়েছে। তাঁর স্বামী এবং ছোট ভাই রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা,বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা। একাত্তরের দিনগুলোতে অন্ধকারে নিপতিত হয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর পরিবার। হানাদারদের আক্রমণের কারণে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন তো হারিয়েই গিয়েছিল। তবে দেশ স্বাধীনের পর নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। তাদের বাড়ির অদূরে খুরুশিয়া পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতো। যুদ্ধের প্রথমদিকে সুখবিলাস স্কুলে লঙ্গরখানা খুলেছিল। সেখানে বড় বড় ডেকচি দিয়ে রান্না করতে হতো। কোনো কোনো সময় ৫০ জনের জন্যও রান্না করতেন।’ মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোর সাক্ষী কামরুন নাহার বেগম বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার পর পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল তারা। হাছান (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী) ও এরশাদকে (মেজো ছেলে) নিয়ে পাহাড়ে থাকতে হয়েছিল। আমার স্বামী তখন কোনদিকে থাকতো জানতামনা। যেদিন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেদিনই আমার মেয়ের জন্ম হয়, সে এখন ডাক্তার। তেমন কাপড় ছিল না, কাঁথা ছিল না। আর্থিকভাবে গরীব মানুষ যেমন, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। থামি কাপড় খুঁজে পরতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা দিন পার করেছি।’
সর্বোপরি তিনি একজন জীবন সংগ্রামী নারী এবং দেশ ও মানব কল্যাণে আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। তার আগমনে, তার সুকর্মে এ ধরাধামে যে খুশির বার্তা বয়ে চলে,যে মানবতার জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে চলেছেন, যার জন্যে জীবনটাকে করেছেন সংগ্রামের হাতিয়ার,সে জীবনের বাঁকি অংশও তিনি এভাবেই পরিচালিত করতে বদ্ধপরিকর।