বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে বিদেশি ঋণ গ্রহণে আপত্তি তুলেছে সরকারের ‘অনমনীয় ঋণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি’ (এসসিএনসিএল)।
বিধি মোতাবেক যে কোনো প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে বিদেশি ঋণ নেয়ার প্রস্তাব এ কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়।
কিন্তু এ প্রকল্পের ১৫ শতাংশ ভৌত অবকাঠামোর কাজ শেষে ৬৪৭৫ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য এ কমিটিতে পেশ করা হয়েছে। এতে প্রশ্ন তুলেছে কমিটি। বলা হয়েছে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড আর্থিক কার্যক্রম ব্যাহত করবে। কাজ শুরুর আগে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব উপস্থাপন না করার বিষয়টি বোধগম্য নয়।
বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। সূত্র জানায়, আর্থিক শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য ‘অনমনীয় ঋণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির’ সভাপতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর পর ঋণ নেয়ার প্রস্তাব এ কমিটিতে উপস্থাপনের কারণ অবগত নই। কাজ শুরুর আগে এ কমিটিতে ঋণটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো অত্যাবশক ছিল।
কমিটির অনুমোদন ছাড়া কাজ শুরু হলে তা ফাইন্যান্সিং কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে। অর্থমন্ত্রী ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজের বিষয়ে সতর্ক করে দেন। পাশাপাশি বিদেশি ঋণের প্রস্তাব প্রথমেই এসসিএনসিএল (স্ট্যান্ডিং কমিটি অন নন-কনসেশনাল লোন) কমিটিতে দ্রুত পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, পটুয়াখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা বা ২৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। এই মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ। এই ঋণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা হয়। এরপর ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ব্যাংক অব চায়না।
এই ব্যাংক থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়। পরে আলোচনার মাধ্যমে ঋণের খরচ ১৮৭০ কোটি টাকা বা ২২ কোটি মার্কিন ডলার কমানো হয়। পরে এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে ব্যাংকের একটি সম্পত্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই ঋণের মেয়াদ হচ্ছে ১৫ বছর। সূত্র মতে, সম্প্রতি এই ঋণের প্রস্তাব পাসের জন্য উপস্থাপন করা হয় সরকারের অনমনীয় ঋণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভায়।
কিন্তু ঋণের প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, রিস্টেলমেন্ট ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতসহ ১৫ শতাংশ ভৌত অবকাঠামোর কাজ ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। কারণ যে কোনো প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন নিতে হয় এসসিএনসিএল কমিটির সভায়। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি।
ওই বৈঠকে অর্থ সচিব (সিনিয়র) আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, এ ঋণ পরিশোধের দায়-দায়িত্ব কোম্পানির হলেও সরকারের ১৫ শতাংশ অংশীদারিত্বের কারণে সরকারের ওপর এর দায় বর্তায়। এজন্য প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক কার্যক্রমে নীতি-পদ্ধতি পালন করা আবশ্যক।
তবে কেন ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বৈঠকে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অবসর) বলেন, প্রকল্প শুরুর আগে এ কমিটির সম্মতি নেয়া আবশ্যক ছিল। যেহেতু কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে তাই আগে সম্মতি না নেয়ার বিষয়টি মার্জনা করে ঋণ প্রস্তাব পাসের অনুমোদনের অনুরোধ করেন তিনি।
বৈঠকে ঋণ প্রাপ্তির আগেই কাজ শুরুর ব্যাখা দিয়ে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিএলসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সবুর বলেন, পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান-২০১৬ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
এটি আরপিএলসি ও নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন লিমিটেড যৌথভাবে ৫০ শতাংশ অনুপাতে কাজটি করছে। এর আগে প্রকল্পের প্রস্তাবটি পাসের জন্য কয়লা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার এডভাইজার কমিটিতে পাঠানো হয়।
ওই কমিটি আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে এ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে হবে এমন শর্ত বেঁধে দেয়। সময় বেঁধে দেয়ায় ওই হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সময় দেয়া হয়। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর লক্ষ্যে এ প্রকল্পে ২৫ শতাংশ নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করে। এ কারণে প্রকল্পের অনেক কাজের অগ্রগতি হয়েছে। এখন ঋণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত কঠিন শর্তের ঋণের ঝুঁকি হ্রাস ও নমনীয়তা পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য গঠন করা হয় অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটি। এর আগে হার্ড টার্ম লোন কমিটি বাতিল করে নতুন এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি হচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।