খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ড. গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ মাহি বলেছেন, প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা মংপ্রু সাইন নিজের রাজভান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সংক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। মু্ক্িতযুদ্ধে উনার অবদান আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শুধু শিক্ষনীয় নয়, আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। আমরা যদি ‘দেশপ্রেম বা সবার উপরে দেশ’ এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করতে চাই আমাদের মনে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে এরকম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যে অবদান রয়েছে সেগুলো আমাদের সবসময় স্মরণ করতে হবে। তিনি বৃহস্পতিবার (৩০মার্চ) দুপুরে খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ অডিটরিয়ামে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সাইন’র স্মরণে শিক্ষাবৃত্তি ও সার্টিফিকেট প্রদান আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রিজিয়ন কমান্ডার আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে এ শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মংপ্রু সাইনের এ অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যা ভবিষ্যতে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং দেশের জন্য আত্মত্যাগের যে মহিমা, সে চেতনা শিক্ষার্থীদের জাগ্রত করা।পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা। শিক্ষার্থীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। যাতে করে শুধু খাগড়াছড়ি নয়, পুরো বাংলাদেশে মেধা-অবদান দিয়ে দেশ-জাতির জন্য তাদের সেবা দিয়ে নিবেদিত করতে পারো।সেই ভূমিকায় অগ্রনী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারো। সর্বোপরি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একজন সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে চরিত্র গঠনের মাধ্যমে আলোকিত একজন মানুষ হিসেবে সমাজের আলো বিলিয়ে দেওয়ার আহবান জানান তিনি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি মং সার্কেল চীফ সাচিংপ্রু চৌধুরী, বিজিবির সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, খাগড়াছড়ির প্রাক্তন সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান, পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক পিপিএম। খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ এর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি রিজিয়নের স্টাফ অফিসার(জিটুআই) মেজর মো. জাহিদ হাসান। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল রুবায়েত আলম, পিএসসি, খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. সুধীন কুমার চাকমা ও সহযোগি অধ্যাপক (অবঃ) মধু মঙ্গল চাকমা, খাগড়াছড়ি রিজিয়নের আওতাধীন বিভিন্ন জোনের কমান্ডার, অধিনায়ক, হেডম্যান, কার্বারী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। প্রসঙ্গত, মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ মংপ্রু সাইনের বিরল অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত না পেলেও খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন ২০১৮ সালে তার নামে শিক্ষাবৃত্তি চালুর মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সে থেকে প্রতি বছর খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন সে বৃত্তি দিয়ে আসছে। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর এমন মহতি উদ্যোগ চির দিন উদাহরণ হয়ে থাকবে। জানা গেছে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্নে ১নং সেক্টরের অন্যতম সূতিকাগার ছিল রামগড়। চট্টগ্রাম থেকে রামগড় যাবার পথেই মানিকছড়ির মং সার্কেল চীফ মং প্রু সেইনের বাড়ি’র অবস্থান। ফলে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগঠকদের সহজ যাতায়াত পথ ছিলো ফটিকছড়ি থেকে মানিকছড়ি হয়েই। জীবন বাঁচাতে পলায়ন উম্মুখ হাজার হাজার শরণার্থীরা মাঝপথে বিশ্রামের জন্য বেঁচে নিয়েছেলেন ‘মং রাজবাড়ি’-কে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িস্থ ‘মং রাজ বাড়ি’ বৃহত্তর চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের কাছে ছিল নির্ভরতার এক অনন্য ঠিকানা। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি লাগোয়া এই রাজবাড়ি’র কর্ণধার প্রয়াত মং সার্কেল টিফ মংপ্রু সেইন মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উদার চিত্তে শামিল হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও রসদ প্রদানে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল প্রধানের মধ্যে একমাত্র মং সার্কেল চিফ মং প্রু সেইন ই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিলেন। রাজ ভাণ্ডার উদার করে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের কাতারে। তিনিই আমাদের অস্থায়ী সরকারের কাছে ১১শ ডলার দান করেছিলেন। যা ছিল প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের ঘটনা। শুধু কী তাই, তিনি রাজ পরিবারের ৩৩টি বন্দুক এবং কয়েকটি দামি গাড়িও তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। কিন্তু তার এ অবদান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি মেলেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চীফ মংপ্রু সাইন’র বিরল অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন উদ্যোগ নেয়। সে থেকে প্রতি বছর খাগড়াছড়িতে এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘মং সার্কেল চিফ বীর মুক্তিযোদ্ধা মং প্রু সাইন’ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়।