দলের নেতৃত্ব নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় জন্য ভুল স্বীকার করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বৃহস্পতিবার দলের হাইকমান্ডকে চিঠি দিয়েছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো চিঠিতে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, দলের নেতৃত্ব নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় তিনি মর্মাহত, দুঃখিত ও লজ্জিত। একই সঙ্গে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবে বিবেচনা করার জন্যও তিনি অনুরোধ করেন।
খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বক্তব্য দেন। তাদের এমন বক্তব্যে দলের একটি অংশ চরম ক্ষুব্ধ। তারা মনে করেন, নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি ওঠে।
বৃহস্পতিবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো চিঠিতে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বেশ কিছু দিন ধরে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। দেশে মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে রাজনৈতিক ও সামাজিক সব কাজ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন আছি। এরূপ পরিস্থিতিতে ৩ অক্টোবর একটি চ্যানেলের একজন রিপোর্টার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। মূল সাক্ষাৎকারের আগে ও পরে অনেক দীর্ঘ আলোচনা হয়। যার অনেক কিছুই ছিল অপ্রাসঙ্গিক। পরে তারা এমনভাবে আমার সাক্ষাৎকার সম্পাদনা ও সম্প্রচার করে যা আমাদের দলের জন্য ছিল বিব্রতকর এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য ছিল লজ্জাকর। প্রচারিত বক্তব্য আমার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান, দায়িত্ব ও বিশ্বাসের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া তথা বিএনপির কোটি কোটি সমর্থকের জন্য এটা ছিল কষ্টের। এ জন্য আমি মর্মাহত, দুঃখিত ও লজ্জিত। আমি আমার সব বক্তব্য প্রত্যাহার করছি। আগামী দিনগুলোতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ও আপনার নেতৃত্বে সাধ্যমত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবশ্য উপস্থিত থাকব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, আমি দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছি। কারণ দলের শীর্ষ নেতা সম্পর্কে আমার বলাটা ঠিক হয়নি- এটা আমি স্বীকার করছি। আবার এটাও ঠিক আমার খণ্ডিত বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। আমি অসুস্থ। ওই দিনের ঘটনা বিস্তারিত জানিয়েছি। আশা করি দল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে।
সূত্র জানায়, টিভি চ্যানেলটিতে তিন পর্বে তিন নেতার বক্তব্য প্রচার করা হয়। এতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়া কিসের আপসহীন। আপস না করলে উনি জেল থেকে বেরোলেন ক্যামনে। সরকারের কথা শুনে, সমঝোতা করেই তো তিনি বেরিয়ে এসেছেন। খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী হিসেবে। অথচ জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার তিনি করলেন না কেন?’
শাহজাহান ওমর বলেন, ‘তারেক রহমান থাকেন লন্ডনে। আর লন্ডনে বসে কথা বা ভাব আদান-প্রদান করা খুব কঠিন। উনি মাঝে মাঝে স্কাইপিতে কথা বলেন, আমাদের সঙ্গেও যে বলে না-তা না। এতে দলকে কতখানি এগিয়ে নেয়া যাবে! হ্যাঁ, বিদেশে থেকেও রাজনীতি করা যায়, সেরকম ইরানের খোমেনি করেছিলেন। ১৫ বছর ফ্রান্সে ছিলেন, দেশেও ফিরেছিলেন। এমন আরও অনেক নেতা আছেন। কিন্তু তারেক রহমান কতটুকু পারবেন- আপনারাও দেখেন, আমিও দেখি।’
মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা নেতাকর্মীরা আপস করে ফেলেছি। আমরা জেলে যেতে চাই না। কোনো ধরনের নির্যাতন-কষ্ট ভোগ করতে রাজি না- এটাই মনে হচ্ছে বর্তমানের পরিস্থিতি। সুতরাং খালেদা জিয়ার মনোবল এখনও শক্ত আছে। তিনি দৃঢ় মনোভাবসম্পন্ন। কিন্তু দলের দুর্বলতার কারণে তাকে এ কারাবাস মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এখন হয়তো মনে হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসনকে সরব ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু জনমনে তার যে স্থায়ী আসন তার কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। খালেদা জিয়াই বিএনপির বর্তমান ও ভবিষ্যতের একমাত্র নেতা। তারপরে কে জানি না।’
দলীয় সূত্র জানায়, তিন ভাইস চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠলেও দলের একটি অংশ এর বিরোধিতাও করে। কারণ তিনজনই মুক্তিযোদ্ধা, এর মধ্যে দু’জন খেতাবপ্রাপ্ত। তাই মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসামান্য ভূমিকার বিষয়টি বিবেচনায় রাখে দল। তবে তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর এখন নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক। এমন পরিস্থিতিতে ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তার বক্তব্যের জন্য দলের হাইকমান্ডকে চিঠি দিয়ে ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
জানতে চাইলে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, ‘আমার তো চিঠি দেয়ার কিছু নেই। আমার বক্তব্যের একাংশ প্রচার করা হয়েছে। বক্তব্যকে কিছুটা টুইস্ট করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মানি না এ কথা তো আমি বলিনি।
তিনিই তো আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই বিএনপি শক্তিশালী হচ্ছে।’ আর হাফিজউদ্দিন আহমদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
দলের একটি অংশ মনে করে, গণতান্ত্রিক একটি দলে নিজের মতামত যে কেউই প্রকাশ করতেই পারে। ভুল হলে তাদের সতর্ক করা যায়। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবা উচিত নয়।
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, সিনিয়র তিন নেতার এভাবে বক্তব্য দেয়া ঠিক হয়নি। যদি কোনো ক্ষোভ থেকে থাকে তা দলীয় ফোরামে বলতে পারতেন। হয়তো তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। দলের হাইকমান্ডসহ নেতাদের কাছেও তাদের সম্মান অন্যরকম। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।