দলে ‘চেইন অব কমান্ড’ রক্ষায় হার্ডলাইনে বিএনপি। কেউ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। এর অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহে বহিষ্কার করা হয়েছে ১৪ নেতাকে।
দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদেরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহের ইন্ধনদাতাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করা হচ্ছে। এরপরও যারা হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে দলে কোন্দলে ইন্ধন দেবে তাদের বিরুদ্ধেও নেয়া হবে ব্যবস্থা। দলের এমন কঠোর বার্তা ইতোমধ্যে তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কেউ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান আমাদের গঠনতন্ত্রেই আছে। কেউ গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করলে অতীতে ব্যবস্থা নিয়েছি, বর্তমানে নিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও নেব।
তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা তদন্ত কমিটি করি। সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। সেখানে ঘটনার ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতামত থাকলে সেটাও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকি।
সূত্র জানায়, করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া স্থগিত ছিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত মাস থেকে সীমিত পরিসরে পুনর্গঠন কাজ শুরু করে বিএনপি। পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে কোন্দল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে দলটির হাইকমান্ড।
ইতোমধ্যে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠন কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। বিভিন্ন জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌর কমিটি পুনর্গঠনের সময় এ ক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন ঘিরে সারা দেশে কোন্দল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। আসন্ন পৌর নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে একাধিক গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। প্রার্থী ঘোষণার পর অনেক স্থানেই বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের। বিশেষ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় হামলার পর নড়েচড়ে বসেছেন তারা। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের চেইন অব কমান্ড নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে প্রায় সব নেতা একই সুরে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দলে শৃঙ্খলা ধরে রাখার বিকল্প নেই। পুনর্গঠন বা মনোনয়নকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে কোন্দল বা বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে এখন থেকেই কঠোর হতে হবে। শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করে কেউ রেহাই পাবেন না-তৃণমূলে এমন একটা বার্তা দিতে হবে।
এ লক্ষ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। দলের এমন কঠোর সিদ্ধান্তের বিষয়টি মহানগর উত্তর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়।
এরপর মির্জা ফখরুলের বাসায় হামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মহানগর উত্তরের ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েক নেতাকেও বহিষ্কার করা হয়। কোনো তদন্ত কমিটি গঠন না করে হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, ওই ঘটনার ইন্ধনদাতাদের ফোন করে সতর্ক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিদ্রোহে ইন্ধন দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন কেন্দ্র করে এসএম জাহাঙ্গীর ও কফিলউদ্দিন সমর্থকদের মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর গুলশান কার্যালয়ের সামনে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনা তদন্তে দায়িত্ব দেয়া হয় দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে। ইতোমধ্যে তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। সেই প্রতিবেদনে সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। শিগগির তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।
জানতে চাইলে খায়রুল কবির খোকন বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। যারাই শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যথায় দলে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু থাকবে না। গুলশানের ঘটনায় যারা জড়িত, তারাও রেহাই পাবে না। ওই ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছি। আশা করি, নীতিনির্ধারকরা দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
রোববার আজীবন বহিষ্কার করা হয় পটুয়াখালী জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওয়াহিদ সরোয়ার কালামকে। সম্প্রতি পটুয়াখালী বার মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের উদ্যোগে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় একটি প্রতিনিধি দলও উপস্থিত ছিল।
এতে বক্তৃতা দেয়ার সময় কালাম দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তার এমন বক্তব্যে উপস্থিত নেতাকর্মীরাও বিস্মিত হন। ওইদিনের বক্তব্যের ভিডিওসহ তার বিরুদ্ধে দলের শৃৃঙ্খলাপরিপস্থী কর্মকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সবকিছু বিশ্লেষণ করে তাকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। ৯ অক্টোবর বহিষ্কার করা হয় সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক মাসুম মাহমুদ তালুকদারকে।