এক বছরে ২৪ হাজার অগ্নিকাণ্ড, অর্ধেকই গ্যাস-বিদ্যুতে
যত দিন যাচ্ছে দেশে অগ্নিকাণ্ড বা অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একইসঙ্গে বাড়ছে এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। গত বছর দেশে ২৪ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার অর্ধেকেই গ্যাস বা বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ঘটেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নেওয়ায় বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে, চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। কিছুদিন পর আবার সেই আগের অবস্থা।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ঘটেছে ৯ হাজার ২৭৫টি। গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুন থেকে ঘটেছে ৭৯৫টি, স্থিরবিদ্যুৎ থেকে ১৯টি, সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ঘটেছে ৯৪টি অগ্নিকাণ্ড। চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ৩ হাজার ৩৬৮টি, যার অধিকাংশই গ্যাস ও ইলেকট্রিক চুলা থেকে।
চলতি বছরও বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি মার্চ মাসেই তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
গত ৭ মার্চ বিকেল পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তানে বিআরটিসির বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে সাততলা একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ২৫ জনের মত্যু হয়। আহত হন দেড় শতাধিক মানুষ। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা গ্যাস থেকে হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ভবনের নিচে ছিল গ্যাসের লাইন। সেখানে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ছিল না। তাই লাইনের লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস জমা হয়ে যায়। সেই গ্যাস থেকেই শর্টসার্কিট বা দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর মধ্য দিয়ে হয় বিস্ফোরণের সূত্রপাত।
তবে লাইনের লিকেজের বিষয়টি মানতে নারাজ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। গ্যাসের লাইনে লিকেজ থাকা বা অবৈধ গ্যাসলাইন ও পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না থাকার বিষয়ে নতুন করে কোনো মন্তব্য করতে চায় না তিতাস। নতুন করে কিছু না বলতে চাইলেও বিস্ফোরণের পাঁচ দিন পর ১২ মার্চ সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল ওই ভবন পরিদর্শন করে। তখন তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং দক্ষিণ) শামসুদ্দিন আল আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, তিতাসের গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ হয়নি। আমরা এখনো গ্যাসের আলামত পাইনি। এ দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক গ্যাস সৃষ্ট নয়।
এর মাত্র দুইদিন আগে ৫ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ৬ জন মারা গেছেন। এছাড়া এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ৪০ জন। জমে থাকা গ্যাস থেকেই সায়েন্সল্যাব এলাকার ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল।
দলের ইনচার্জ রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, জমে থাকা গ্যাস থেকেই এ বিস্ফোরণ ঘটেছে। আমরা ধারণা করছি, সুয়ারেজ লাইন বা কনসিল গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস জমায় এ বিস্ফোরণ হয়েছে। আমরা ডিটেক্টর দিয়ে ঘটনাস্থলে গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছি। যখন বাতাসের সঙ্গে ৫ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস মিশে যায়, ওই স্থানে সুইস অন করলেও তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরণ ঘটবে।
৪ মার্চ বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ছয়জন নিহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা যান। আহত হন অন্তত ২৫ জন। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত।
এছাড়া গত বছরের (২০২২) ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। আগুনে দগ্ধ হয়ে আহত হন অন্তত দুই শতাধিক।
২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শিশুসহ ৩৪ মুসল্লির মৃত্যু ঘটে। ওই ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হয়। সেই বিস্ফোরণের ঘটনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরসহ অনেকেরই টনক নড়ে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে তিতাস সংযোগ লাইনের লিকেজে মসজিদের ভেতর গ্যাস জমা এবং হঠাৎ বিদ্যুৎ স্পার্কিংয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটার বিষয়টি সামনে চলে আসে। পাশাপাশি মসজিদ কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কথাও বলা হয়। সেই ঘটনায় করা মামলায় সিআইডি তদন্ত শেষে ডিপিডিসি, তিতাস ও মসজিদ কমিটির আটজনকে আসামি করে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
এদিকে প্রায়ই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা শোনা যায়। গত ১৩ মার্চ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রীবাহী এক মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডে ৪ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় আরও ৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ত্রিশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু বকর সিদ্দিক জানান, মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের পাশে পড়ে যায় এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।
একের পর এক এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। দুর্ঘটনার পরে বেরিয়ে আসে নানা ধরনের অসঙ্গতির তথ্যও। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার পরে এর দায় নিতে চায় না কেউ। বিদ্যুৎ গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান, সিলিন্ডার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে।
এসব দুর্ঘটনায় যেমন বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে তেমনি হচ্ছে আর্থিক ক্ষতিও। ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে জানান, শুধু ২০২২ সালেই অগ্নি দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। এছাড়াও ২০২১ সালে ২১৮ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটার পরে নয়, সচেতন হতে হবে আগে থেকেই। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেমন দায়বদ্ধতা আছে তেমনি বড় দায়বদ্ধতা হচ্ছে কনজ্যুমারদের। গ্যাস দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেসব বাসায় গ্যাস ব্যবহার করা হয় সেসব বাসা-বাড়িতে ভেন্টিলেশন থাকতে হবে। যেখানে গ্যাসের চুলা আছে সেখানে ভালো ভ্যান্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। উপরে খোলামেলা থাকতে হবে যেন গ্যাস লিকেজ হলে সেটা বের হয়ে যায়। এসব দেখভাল করার দায়িত্ব তিতাসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর অনেক ধরনের কথা হয় কিন্তু আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় দেখা যায়। দোকান-পাটে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। যেখানে বৈদ্যুতিক তারের যতটুকু সক্ষমতা তার থেকে বেশি ভোল্টেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে দায় তো সবারই। যে অবৈধ সংযোগ নিচ্ছে তার, আবার যারা দিচ্ছে তাদেরও। ভোক্তা পর্যায়ে সবকিছু সঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব বিদ্যুৎ বিভাগের। মূল কথা আগে থেকে সবাই সচেতন হলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।