জাহাজ পরিচালনায় বিশ্বমানের ক্যাডেট প্রশিক্ষনে দেশে এই প্রথম ‘সিমুলেটর কমপ্লেক্স’ স্থাপন করছে চট্টগ্রামের সরকারী ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (এনএমআই)। মেরিটাইম সেক্টরে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এবং আর্ন্তজাতিক মানদন্ডে প্রতিযোগিতায় সক্ষম জনবল তৈরীর অংশ হিসেবে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় এটি স্থাপন করছে। প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটির নির্মানকাজ শুরু হয়েছে; ২০২১ সালের জুনের মধ্যেই কাজ শেষ হওয়ার আশা কর্তৃপক্ষের।ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) নিদের্শিত নিয়মে ক্যাডেট প্রশিক্ষনে অবশ্যই ‘সিমুলেট বেইজড’ প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের অন্য ক্যাডেট প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠান যেমন-বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি ও বেসরকারি একাডেমিগুলোতে সিমুলেটর থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সরকারী ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে সিমুলেটর কমপ্লেক্স স্থাপন হলে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ নাবিক তৈরীতে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে যাবে; নতুন মাইলফলক স্থাপিত হবে। এই সিমুলেটর দক্ষিন এশিয়ায় প্রথম বলছে মেরিটাইম সেক্টরের কর্মরত।ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট এর অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম বলছেন, দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে সিমুলেটর বেইজড সমন্বিত ট্রেনিং এর জন্য এই ধরনের স্থাপনা এটাই প্রথম। ব্রিজ, ইঞ্জিন, জি. এম. ডি. এস. এস. ছাড়াও ট্যাংকার, কেমিক্যাল ট্যাংকার ও গ্যাস ট্যাংকার সিমুলেটর থাকছে এখানে। তাছাড়া বয় হ্যান্ডেলিং টাগ, ক্রেন অপারেশন, হাই ভোল্টেজ, সালফার ক্যাপ, ব্যালাস্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিমুলেটর এর সাথে যুক্ত থাকছে। আভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গুলো এই সিমুলেটর এর সাথে যুক্ত থাকছে, ফলে ইংল্যান্ড ও কোস্টার জাহাজের নাবিকদেরও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হবে। মেরিটাইম সেক্টরের চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম বলছেন, নৌ চলাচল নিরাপদ রাখার স্বার্থে নাবিকদের প্রশিক্ষিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি নির্দেশনাও রয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় আগামীর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সিমুলেটর স্থাপন করছে। প্রায় ৪০ কোটি ব্যয়ের এই প্রকল্পের ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে; এখন ভৌত অবকাঠামো নির্মানকাজ চলছে। আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময় ২০২১ সালের জুনের মধ্যেই এটি সম্পন্ন হয়ে যাবে।’তিনি বলছেন, এই প্রকল্প শুরুর পর কভিড মহামারির কারণে দেশে লকডাউন শুরু হয় কিন্তু আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কভিডের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ চালিয়েছি; এরফলে প্রকল্পে করোনার প্রভাব খুব বেশি প্রভাব পড়তে দিইনি।আমরা ইতোমধ্যে দুটি সিমুলেটর কিনেছি, সরকারীভাবে আরো একটি কেনার প্রক্রিয়া চলছে।জানা গেছে, বাংলাদেশে সরকারী ‘বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি’তে ডেক ক্যাডেটদের প্রশিক্ষনে সিমুলেটর থাকলেও, ইঞ্জিন ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণে প্রয়োজনীয় সিমুলেটর নেই। তবে ক্যাডেট প্রশিক্ষণের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘আই এম এ’ সিমুলেটর বেইজড ট্রেনিংএ সরকারি ও বেসরকারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গুলো থেকে কিছুটা এগিয়ে আছে।জানতে চাইলে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কেএম জসিম উদ্দিন সরকার শিপিং এক্সপ্রেসকে বলেন, আগে ক্যাডেটদের জাহাজে উঠেই এই প্রশিক্ষনটা নিতে হতো কিন্তু পরবর্তীতে সেটি কঠিন হয়ে পড়লো। এই কারণে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) জাহাজে না উঠে জাহাজের মতোই রিয়েল টাইম, রিয়েল এনভায়রনমেন্ট ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করলো। এরপর থেকেই মুলত সিমুলেটর বেইজড ট্রেনিং শুরু হলো।তিনি বলছেন, এনএমআই যে সিমুলেটর বসাচ্ছে সেটি সবচে আধুনিক এবং সমন্বিত বলে জেনেছি। এর মাধ্যমে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ক্যাডেটরা অবশ্যই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। প্রশিক্ষন নেয়ার পর সরাসরি জাহাজে উঠে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবে। বিশ্ববাজারেও তারা এগিয়ে থাকবে কোন সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতের যোগ্য জনবল তৈরীর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার চট্টগ্রাম ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে রেটিং(কর্মী) প্রশিক্ষনের পাশাপাশি মেরিন ক্যাডেট প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই সিমুলেটর কমপ্লেক্স নির্মান করছে।সিমুলেটর বেইজড ট্রেনিং থাকলে একজন ক্যাডেট কিভাবে এগিয়ে থাকবে—জানতে চাইলে মেরিন একাডেমির নৌ শিক্ষা বিভাগের প্রধান ও ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘একজন ক্যাডেট খোলা জাহাজ, কনটেইনার জাহাজ ও ট্যাংকার জাহাজের প্রশিক্ষণ পান। কিন্তু এনএমআইয়ের আধুনিক ও সমন্বিত সিমুলেটর দিয়ে বিশেষায়িত কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে, যা বাংলাদেশে প্রথম ও একেবারে নতুন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রিমোর্ট অপারেটেড ভেসেল, অফশোর ভেসেল এবং এলপিজি-এলএনজিভিত্তিক জাহাজ পরিচালনা। তিনি বিলেন, শুধু জাহাজ পরিচালনাই নয়, এই কেন্দ্রে বন্দর পরিচালনায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ভারী যন্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণও দেওয়া যাবে। এখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা বিদেশে দক্ষ কর্মী হিসেবে চাকরি পাবে; যার চাহিদা প্রচুর। জানা গেছে, সরকার বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় সক্ষম নাবিক তৈরী করতে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটকে সর্বাধুনিকভাবে গড়ে তুলছে। গত আট বছরে এই প্রতিষ্ঠানের আমুল পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে বর্তমানে রেটিং ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে; বছরে সক্ষমতা ৬শ জন। রেটিং তৈরী করতে সরকার ইতোমধ্যে মাদারীপুরে শাখার অনুমতি দিয়েছে; যেটির অবকাঠামো নির্মান চলছে। মাদারিপুরের প্রশিক্ষন চলছে চট্টগ্রামে। একইসাথে কুড়িগ্রামেও ইনস্টিটিউটের একটি শাখা স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।