সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ নিজই সরকারী সুবিধা নিয়ে টাকার বিনিময়ে খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রপাচার করার ১২ ঘন্টা পরে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অস্ত্রপাচারের পরে রক্ত বন্ধ না করতে পারায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নিহত প্রসূতি নাসিমা খাতুন (৩৯) উপজেলার মসজিদকুড় গ্রামের আবুল হোসেন মিস্ত্রীর স্ত্রী। হাসপাতাল ও রোগীর আত্নীয় সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সন্তান প্রসাবের লক্ষণ দেখা দিলে প্রসূতি নাসিমা খাতুনকে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। পরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র নার্স শ্যামলী ও চায়নার সাথে কথা বলে টাকার চুক্তি করে রোগীর আত্নীয় স্বজন। শ্যামলী ও চায়না সিজার করতে ৮ হাজার টাকা দাবী করলে স্থানীয় একজনের সুপারিশে ৭৫০০ টাকায় চুক্তি হয়। নগদ ৬ হাজার টাকা ও পরে আরো ১৫০০ টাকা দিতে হবে এই শর্তে ডেলিভারীর ব্যবস্থা করা হয়। এসময় শ্যামলীর উপস্থিতিতে চায়নার হাতে নগদ ৬ হাজার টাকা দেন রোগীর ভাই কামরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০ টার দিকে অপারেশন থিয়েটরে রোগীকে আনা হয়। এর আগে চিকিৎসকের নির্দেশে ফিটনেস পরীক্ষার জন্য একটি ডায়াগনেস্টিক সেন্টার থেকে রক্তের কয়েকটি পরীক্ষাসহ ইসিজি করানো হয়। ইসিজি রিপোর্ট ভালো থাকায় অস্ত্রপাচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসক। ওই পরীক্ষায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান ছিল ৫৮%। অস্ত্রপাচারের পরে রোগী বেডে দেওয়ার বেশ কিছুক্ষন পরে শীতে কাপুনির সৃষ্টি হলে দায়িত্ব প্রাপ্ত নার্সদের রোগীর আত্নীয় স্বজনরা জানান। গায়ে কাপড় থাকায় রক্তক্ষরনের বিষয়টি রোগীর সাথে থাকা আত্নীয় স্বজনরা প্রথমে জানতে পারেননি। ক্রমাগত অবস্থার অবনতি হলে ডা. সুজাত আহমেদকে অনেক খোঁজা-খুজি ও ডাকাডাকি করেন। তবে মৃত্যুর আগে তাঁর স্বাক্ষাত মেলেনি। একপর্যায়ে কর্মরত নার্স রোগীর লোকদের এ পজেটিভ রক্তের ব্যবস্থা করতে বললে তাৎক্ষনিক ১ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে দেয়া হয়। পরের দিন সকালে অর্থাৎ শুক্রবার সকাল ৭ টার দিকে আরো ৩ ব্যাগ রক্ত জরুরীভাবে সংগ্রহ করার তাগিদ দেয়া হয়। তবে অস্ত্রপাচারের পূর্বে রোগীর অভিভাবককে কোন রক্ত দাতা সংগ্রহ করে রাখতে বলা হয়নি বলে রোগীর আপনজন অভিযোগ করেন। ফলে তাৎক্ষনিক রক্ত সংগ্রহ করতে পারেননি রোগীর আপনজনরা। এছাড়া আরো অভিযোগ রয়েছে অপারেশনের সময় সেখানে অজ্ঞানের ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন না। তাছাড়া জরুরী প্রয়োজনের জন্য রক্তের কোন ব্যবস্থাও ছিল না সেখানে। সিভিল সার্জন অপারেশন করে টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পরে সমস্যার সৃষ্টি হলেও হাসপাতালের কোন চিকিৎসককে ডেকে পাওয়া যায়নি। পরে ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে রক্তদাতা সংগ্রহ করতে পারলেও কোন লাভ হয়নি। ততক্ষনে ১২ ঘন্টা বয়সের এক নিস্পাপ পুত্র সন্তান রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন প্রসূতি নাসিমা খাতুন। এরই মধ্যে রোগীর জন্য হাসপাতালের বাইরে থেকে প্রায় ৪ হাজার টাকার ওষুধ কিনে দিতে হয়েছে রোগীর স্বজনদের। অভিযোগ রয়েছে মৃত্যু লাশটিও স্বজনদের আসার সময় না দিয়ে বেড থেকে নামিয়ে হাসপাতালের সামনে বের করে দেয়। তবে দেয়া হয়নি কোন ডেড সার্টিফিকেটও। আরো জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে ২/৩ দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারী সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে সিভিল সার্জন নিজে ফি নিয়ে রোগী দেখার কারনে উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে বিরোধ না করে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ওই সময়টা দায়িত্ব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন কর্মরত চিকিৎসকরা। এসময় একদিকে কোন ডাক্তার সিভিল সার্জনের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া কোন রোগীর দায়িত্ব নিতে চান না। অপরদিকে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চিকিৎসা না দিয়েও দায় এড়াতে পারেন না। ফলে কর্মরত চিকিৎসকদের পড়তে হয় চরম বিড়াম্বনায়। প্রসূতির ভাই গ্রাম পুলিশ কামরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, হাসপাতালে ভর্তির পর স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের নার্স চায়নার মাধ্যমে ৭ হাজার ৫ শত টাকা চুক্তিতে তার বোনের অপারেশন করেন ডাঃ সুজাত আহমেদ। ৬ হাজার টাকা নগদে চায়নার কাছে দেন তিনি। ওটি ইনচার্জ নিপা বলেন, রোগীর আত্নীয়দের শুক্রবার (আপারেশনের পরের দিন) সকাল ৭ টার দিকে ৩ ব্যাগ রক্ত আনতে বললে তারা তাৎক্ষনিক রক্ত আনতে ব্যর্থ হন। এর আগে ১ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছিল।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সূদীপ বালা বলেন, ‘উনি (সিভিল সার্জন) আমাদের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা। আমরা সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারিনা। তবে তিনি প্রতি সপ্তাহে দুই দিন এসে হাসপাতালে যেটা করেন তাতে আমরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ি। এর আগেও তাঁর অপারেশন করা এক রোগী মারা যাওয়ায় নানা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাদের। তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, টাকা নিয়ে রোগী অপারেশনের বিষয়ে উপজেলা সমন্বয় সভায়ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তিনি কোন কিছুতেই থামছেন না। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয়ভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ বিষয়ে জানতে খুলনা সিভিল সার্জন ডাঃ সুজাত আহমেদ বলেন, রোগীর বয়স বেশি ছিল। আর তাকে সিজার করা হয়নি। বাচ্চার মাথা বেধে যাওয়ায় প্রসবের রাস্তা কেটে দেয়া হয়েছিল। তবে অপারেশনে কোন ত্রুটি ছিলনা। পরে এমআই( আকস্মিক হার্ট এ্যাটাক) এ তিনি মারা যান। খুলনা স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিচালক রাশেদা সুলতানা বলেন, সিভিল সার্জন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিদর্শনে যেতে পারেন। তবে তিনি টাকার বিনিময়ে রোগী অপারেশন করতে পারেন না। তিনি যদি টাকার বিনিময়ে সেবা দেন সেটা অবশ্যই অন্যায়। সুনির্দিষ্ট প্রমান পেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে রোগী দেখেন সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ। এ সময় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ভিজিট নিয়ে রোগীর পরামর্শপত্র দেয়া হয়। তাছাড়া রোগীদের সরকারী সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদের থেকে সিজারে ৭/৮ হাজার, এ্যাপেনডিসসাইটিক্সে ৩/৪ হাজার টাকা নিয়ে অপারেশন করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি করে অস্ত্রপাচার করা ও অস্ত্রপাচার পরবর্তী রোগীর বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হওয়াসহ একাধিক রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটার অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনার অল্প কয়েকদিন আগে কয়রা উপজেলার নাকশা গ্রামের নাসির উদ্দিন সানার মেয়ে আমেনা এর পায়ের পাতায় একটি অপারেশন করার পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে খুলনা মেডিকেলে নেয়া হয়। পরে সেখানে তিনি মারা যান।