কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরোক্ষ প্রভাব থাকলেও সরাসরি কোন রাজনৈতিক চাপ নেই। কিশোর গ্যাং নিমূর্লে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। মিরপুরে ফয়সাল হত্যাকান্ডে জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কিশোর অপরাধে জড়িত মদদদাতাদেরও তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও আইন প্রয়োগে সেটা বড় কোন সমস্যা হবে না। কিশোর অপরাধ নির্মূলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। টিকটক ও লাইকির মতো এমন অনেক অ্যাপস আছে যা উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এসব বিতর্কিত অ্যাপস প্রয়োজনে বন্ধ করা যেতে পারে। ঢাকা শহরে শিশুদের উপযুক্ত খেলার মাঠ, সুস্থ বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কম, যে কারণে শিশুরা অসুস্থ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি আসক্ত হচ্ছে।
আজকের শিশুররাই আগামীর বাংলাদেশ। এদের উপযুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। আজ (২৩ মার্চ, ২০২৪, শনিবার) বাংলাদেশ চলচিত্র উন্নয়ন কপোর্রেশনে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার, ড. খ: মহিদ উদ্দিন এসব কথা বলেন। সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান জনাব হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
সভাপতির বক্তব্যে জনাব হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে মদদ দাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক সদি”চ্ছ ব্যতিত কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে কিশোরদের ব্যবহার করছে। স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তি, চাদাবাজী, মিছিল—মিটিং, দখলবাজী, দলবাজী ইত্যাদি কাজে যাতে শিশু কিশোরদের ব্যবহার করা না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে রাজনৈতিক উচ্চ পর্যায় থেকে প্রশাসনের সর্বস্তরে সদিচ্ছা পোষণ জরুরী। প্রচলিত শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল মনে হলে প্রয়োজনে তা সংস্কার করা যেতে পারে।
কিশোর গ্যাংয়ের সঠিক কোন হিসাব না থাকলেও ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কমবেশি ২০০টির বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের নানা রকম আজগুবি নাম রয়েছে যেমন— কোপাইয়া দে গ্রুপ, বগা গ্রুপ, লাড়া দে গ্রুপ, ঘুটা দে গ্রুপ, ভইরা দে গ্রুপ, গাইরালা গ্রুপ, ডেভিল বয়েজ গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, কিং রন গ্রুপ, লাভ লেন গ্রুপসহ বহু কিশোর গ্যাং রয়েছে সারা দেশে। ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, শিথিল সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি, মাদকের সহজলভ্যতা, দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, সুশাসনের ঘাটতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ নানা কারণে কিশোর ও তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতাকে আরো বেশি উস্কে দিচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, লাইকি, ইমু, মাইস্পেস, হাইফাইভ, বাদুসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিশোর অপরাধের মাত্রাকে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
জনাব কিরন আরো বলেন, কিশোর তরুণদের জন্য বর্তমানে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়েব সিরিজ। কিছু কিছু অনলাইন প্লাটফর্মে তুমুল অশ্লীলতা, নোংড়া সংলাপ, উদ্ভট গল্প দিয়ে ওয়েব সিরিজ প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব ওয়েব সিরিজগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সহজেই কিশোর—কিশোরীরা আসক্ত করে ফেলছে। বিটিআরসিকে এই ধরণের বিতর্কিত ওয়েব সিরিজগুলো সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।এছাড়াও বিতর্কিত অ্যাপস টিকটকের মাধ্যমে তরুণরা সস্তা হিরোইজমের দিকে ঝঁুকে পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোরীদের অনৈতিক কর্মকান্ডের ফাঁদে ফেলছে এসব কিশোর অপরাধীরা। পুল পার্টি, ড্যান্স পার্টি ইত্যাদির নামে প্রতারিত করছে সাধারণ কিশোর—কিশোরীদের।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন নিম্নের দশ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন: ১) কিশোর অপরাধ রোধে রাজনৈতিক উচ্চ পর্যায় থেকে প্রশাসনের সর্বস্তরে সদিচ্ছা প্রদান করা ২) প্রচলিত শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল মনে হলে প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করা। ৩) স্যোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন অনুযায়ী বিতর্কিত অ্যাপসগুলো বন্ধ করতে বিটিআরসিকে উদ্যোগ গ্রহণ করা। রাত ১০ টার পর অতি জরুরী নয় এ ধরণের অ্যাপসগুলো বন্ধ রাখা ৪) স্কুল কলেজগুলোতে পাঠ দানে বৈচিত্রতা তৈরি করে শিশু কিশোরদের আরো বেশি সৃজনশীল কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা। এলাকাভিত্তিক পাঠাগার, খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও বিনোদন ব্যবস্থা করা ৫) পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ৬) সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এলাকার ওয়ার্ড পর্যায়ে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সিটিজেন মনিটরিং কমিটি গঠন করা ৭) আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মহ অভিযানের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংদের বিরদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহন করা ৮) সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে কমিটির মাধ্যমে কাউন্সেলিং গাইডলাইন প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়ন করা ৯) সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা বাড়ানোর লক্ষ্যে কৌশল নির্ধারণ করা ১০) কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রগুলি আধুনিকায়ন করে সেখানে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা।
“সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহারের কারণে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে” শীর্ষক ছায়া সংসদে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে বিতার্কিকদের পরাজিত করে সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, ড. রাশেদা রওনক খান, সাংবাদিক এস এম ফয়েজ, সাংবাদিক মাসুদা লাবনী এবং সাংবাদিক জুমাতুল বিদা। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।