বরিশাল নগরীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যার অধিকাংশেরই নেই কোন বৈধ কাগজপত্র। তার উপর নেই আবার চিকিৎসক বা দক্ষ টেকনিশিয়ানও। প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকপক্ষ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোন প্রতিষ্ঠানে প্যাথলজি রিপোর্টে ব্যবহার করা হচ্ছে মৃত চিকিৎসকের নামও। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ দিন ধরে ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এমন প্রতারণা চলে আসলেও রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিভিল সার্জন দপ্তর।
অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্যবিভাগ ও প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলছে এই প্রতারণা। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিভাগের খোদ কর্মকর্তাদেরই জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছেন। যার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জোরালো কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের। তাদের নীরব ভূমিকার কারণে বেড়ে গেছে দালাল সংখ্যাও।
সম্প্রতি সময়ে রাজধানীর জেকেজি এবং রিজেন্ট হাসপাতালে করোনার রিপোর্ট জালিয়াতির ঘটনার পরে টনক নড়ে বরিশাল প্রশাসনের। এর পর পরই বরিশাল নগরীর দুটি ভুয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান পরিচালনা করেন তারা। এসময় একজন ডিগ্রি ছাড়া চিকিৎসক ও মালিকসহ সাত জনকে কারাদন্ড প্রদান করেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই সাথে সিলগালা করে দেয়া হয় ওই দুটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান। ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা হয়েছে নিয়মিত মামলাও।
এদিকে হঠাৎ করেই দালাল নির্ভর এসব ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান নগর জুড়ে বেশ সাড়া ফেলে। তবে হঠাৎ করেই তাদের এই অভিযান থেমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে নতুন করে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তারা এসব দালাল নির্ভর নামমাত্র ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযানের জোর দাবি তুলেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ বিভাগের ছয় জেলায় মোট এক হাজার ১০৫টি বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল, প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যার মধ্যে ৬৩৯টি’র নেই বৈধ কাগজপত্র। এর মধ্যে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২৯টি বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালের মধ্যে স্বাস্থ্যবিভাগের লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ১১টির। পাশাপাশি ১১৬টি বেসরকারি ল্যাব।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বাইরে বিভাগের ছয় জেলায় প্রায় সাড়ে ৯০০ হাসপাতাল-ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে লাইসেন্সধারী মাত্র ৩০০ মতো। লাইসেন্স বিহিন যেগুলো রয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশই লাইসেন্স পেতে আবেদন দিয়েছেন। আবার আর কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোন ধরনের হালনাগাদের আবেদনও করেনি।
অপরদিকে বরিশাল জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন বাদে শুধুমাত্র বরিশাল জেলায় ১২৭টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যার মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৮৬টির। বাকি ১৪টি বন্ধ হয়ে গেছে। আর আবেদনবিহিন অবস্থায় রয়েছে ১৭টি। যার মধ্যে শুধুমাত্র গৌরনদী এবং আগৈলঝাড়া উপজেলায় ১৩টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। বৈধগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত নবায়নকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৮টি। বাকিদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য চিঠি দিয়েছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে অবৈধভাবে পরিচালিত অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রয়েছে মাত্র সাইনবোর্ড। নেই পরীক্ষা নিরীক্ষার কোন যন্ত্রপাতি কিংবা চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে একজন চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে তৈরি করে দিচ্ছে ভুয়া রিপোর্ট।
এমন ঘটনার বাস্তব প্রমান মেলে নগরীর দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। র্যাব ও ডিবি পুলিশের সহযোগিতায় ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান করে জেলা প্রশাসন। এসময় নগরীর জর্ডান রোড এলাকার দি সেন্ট্রাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুয়া ডিগ্রিধারী একজন চিকিৎসক ও ওই প্রতিষ্ঠানের দুই মালিককে ছয় মাস করে বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মৃত চিকিৎসকের স্বাক্ষর ব্যবহার করে প্যাথলজি রিপোর্ট দেয়া এবং করোনা মৃত্যু হওয়া চিকিৎসকের নাম সাইনবোর্ডে ব্যবহারের প্রমান পান জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ কারণে কারাদন্ড দেয়ার পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
তিনি বলেছেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করেনি বা লাইসেন্স নবায়ন করেনি তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার তদারকির জন্য সিটি কর্পোরেশন ও জেলার সিভিল সার্জনদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘কমিটির কাছ থেকে হালনাগাদ তথ্য পেলে অনুমোদনবিহীন এবং অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।