রফিকুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ
২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বন্যায় যমুনার একটি শাখা নদীর প্রচন্ড ভাঙনে কাজিপুর উপজেলার চরাঞ্চলে নাটুয়ারপাড়া, তেকানি, নিশিন্তপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। ভাঙনে সরকারি আধা-সরকারি মিলিয়ে শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়। এতে প্রায় এক হাজার বাড়িঘর, ৪টি প্রাথমিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেকানি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, তেকানি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ দেড়শ’ একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। শুধু তাই নয়, কাজিপুরসহ পার্শ্ববর্তী মেছড়া ইউনিয়নের বেশকটি গ্রাম ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তেকানী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে যমুনার শাখা নদী বন্ধ করার জন্য মাঝখান দিয়ে ৪০ মিটার প্রস্থ ৩৫’শ মিটার দৈর্ঘ্য বাঁধের জন্য তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়ের কাছে দাবি জানান। জনগণের দাবী ও নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে কোন সরকারি প্রকল্প গ্রহন না করে ২০২৪ সালের ১৯ মার্চ তেকানি ইউনিয়নের তেকানি খেয়া ঘাট হতে পশ্চিম উত্তর দিকে তেকানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ও তেকানি নৌকা ঘাট হতে পশ্চিম দিকে তেকানি চর পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ ৩৫’শ মিটার বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয় এর মুখের কথায় ৮টি ড্রেজার, ৩টি বেকু ও ২’শ শ্রমিক দৈনন্দিন কাজ করতে থাকে। বাঁধ নির্মান চলমানের সময় সরকারি বিধিমতে তানভীর শাকিল এমপি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট পিআইসি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি উপজেলা ত্রাণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ওই ৪ পিআইসি কমিটি স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীর পরামর্শে এ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। তানভীর শাকিল জয় এর বরাদ্দ দিবে মর্মে আশস্ত করে প্রকল্প সমাপ্ত করার নির্দেশ দেন। বরাদ্দ আসছে এই মর্মে বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে বরাদ্দের চেয়ে ৩ গুনের বেশি অর্থাৎ ৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় করে পিআইসি কমিটি। বাঁধ নির্মাণ চলমান থাকার সাথে সাথে ২৫ মার্চ ২০২৪ইং তারিখে তৎকালীন সাংসদ তানভীর শাকিল জয় এমপি’র বরাদ্দ থেকে ৩৬ লাখ টাকা ও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এর দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা থেকে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। ৫ সদস্য বিশিষ্ট গঠিত পিআইসিগুলোতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সভাপতি ও সদস্য সচিব ছিলেন। এ পর্যন্ত বরাদ্দের ৮৬ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্প বরাদ্দের ১২ লাখ টাকাসহ অতিরিক্ত ৩ কোটি টাকা প্রদান করা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা ত্রাণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, চরাঞ্চলের ওই বাঁধ নির্মাণের ব্যয় বরাদ্দের ৮৬ লাখ টাকা পিআইসিকে প্রদান করা হয়েছে। পিআইসির দাবিকৃত অতিরিক্ত কাজের আরো ৩ কোটি টাকার বিষয়টি সংযুক্ত হয়নি। স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর অতিরিক্ত ৩গুনের বরাদ্দ পায়নি পিআইসি কমিটি। আর পিআইসি কমিটির সদস্যরাও পলাতক। পিআইসি কমিটির সদস্যরা পলাতক থাকায় বাঁধ নির্মাণ করতে ৮টি ড্রেজার মালিক, ৩টি বেকুর মালিক ও ২’শ শ্রমিক এযাবত কোন টাকা পায়নি। ড্রেজার, বেকুর মালিক ও শ্রমিকরা তার কাজের মজুরি না পেয়ে বর্তমানে মানবেতন জীবনযাপন করছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তেকানি বাঁধ নির্মানের ফলে কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়নের রেহাই শুড়িবেড়, খাষশুড়িবেড় ও পানাগাড়ি চর, তেকানি ইউনিয়নের তেকানি, দক্ষিন তেকানি, চর কান্তনগর, কান্তনগর, পারখুকশিয়া, মানিক দিয়ার, আদিত্যপুর, হরিনাথপুর, কিনারবেড়, বড়বাড়িয়া ও কোনাবাড়ি, নিশ্চিন্তপুর ইউনিয়নের চর পানাগাড়ি নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। মেছড়া ইউনিয়নের নেকিবাড়ি, ছিয়াশি, হাটপাড়া আলোকদিয়া সহ বেশকটি গ্রাম ভাঙনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেয়েছে। যমুনা নদীভাঙন থেকে রক্ষায় সাড়ে ৩ কিমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ভাঙনকবলিত প্রায় ১৫ গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। বাঁধটি স্থায়িত্ব পেলে জনপদের হাজারও মানুষের জীবন-জীবিকার পথ সুগম হয়। বাঁধ নির্মান হওয়ায় বর্তমানে সরকারি স্থাপনা, বেসরকারি স্থাপনা, বাড়িঘর, কৃষি জমি নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। ড্রেজার মালিক জাহিদুল ইসলাম কুড়ান বলেন, ড্রেজার মালিক ফিরোজ, গোলাম হোসেন, মজনু মিয়া, স্বপন আলী, সেলিম, চান মিয়া ও কবির প্রত্যেকজন ১টি করে ড্রেজার দিয়ে আমরা বাঁধ নির্মাণে বালু ফেলেছি। আমাদের শ্রমিকের মূল্য ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এখনো পায়নি। সাবেক এমপির নির্দেশেই বাঁধে বালু ফেলেছি। গণঅভ্যূত্থানের পর এমপি পলাতক রয়েছে। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিসে গিয়ে দেখি কিছু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকী বরাদ্দের কোন হদিস নেই। আমাদের শ্রমের মূল্য যদি না দেওয়া হয়, তবে আমরা পথের ফকির হয়ে যাবো। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে জোড়ালো আবেদন করছি, বাঁধ নির্মাণ করেছি কিনা, সে বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমাদের ড্রেজার মালিকদের পাওনা টাকা দিতে হাত জোড় করছি। বেকুর মালিক সোহেল বলেন, আমরা ৩টি বেকু দিয়ে দিনরাত্রী কাজ করেছি। বাঁধ নির্মাণও শেষ, তখনিই আওয়ামীলীগ সরকার পালিয়েছে। তানভীর শাকিল এমপিও পলায়ছে। আমাদের কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকী টাকা দেওয়ার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিকট জোর দাবী করছি। শ্রমিকরা বলছে, যারা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়েছে। তারা এখন পলাতক। আমরা কার কাছে যাবো। অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিকট জোর দাবী করছি, আমাদের শ্রমের মূল্য দিতে। আব্দুস সালাম বিএসসি বলেন, আমি একজন স্কুল শিক্ষক। আমি কোন রাজনীতি করি না। বাঁধটি সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করার জন্য সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয় আমাদের এখানে দেখাশুনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ৮৬ লাখ টাকাও আমার হাতে দিয়েছে। আমরা ড্রেজার, বেকু মালিক ও শ্রমিকদের টাকা দিয়েছি। এমপি মৌখিক নির্দেশে আরও ৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত কাজ করানো হয়েছে। এই টাকাগুলো দেওয়ার জন্য সরকার বাহাদুরের নিকট জোর সুপারিশ করছি। ইসলাম আন্দোলন বাংলাদেশ সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সভাপতি মুফতি মুহিবুল্লাহ জানান, স্বৈরাচার এমপি জয় প্রকল্প না দিয়েই তেকানি বাঁধ নির্মাণ করেছে। প্রকল্প না দেওয়ায় ড্রেজার, বেকু ও শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পায়নি। মানুষের পাশে দাড়াতে এসেছি। যেহেতু বাঁধ নির্মাণ করেছে শ্রমিকরা। বাঁধ নির্মাণকারী শ্রমিকরা কোন রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ত নয়। তাই শ্রমিকদের মজুরি দিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
