ePaper

রাজনীতিতে নদী আন্দোলনের প্রভাব

মিহির বিশ্বাস

সমুদ্র জীববিজ্ঞানী, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন ও যুগ্ম সম্পাদক, বাপা। নদী আন্দোলন শুধু প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন না, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে পেরেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভোটকে কেন্দ্র করে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কর্মসূচি পালিত হয়ে থাকে। দখল, দূষণ, বর্জ্য দিয়ে ভরাট করে অনেক নদী ও খাল গুলোকে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। দখল এমনভাবে হয়েছে যে হরিলুট ও নিষ্ঠুর আগ্রাসনকে হার মানিয়েছে। দূর্গন্ধে কিছু নদী এবং অধিকাংশ খালের পাড়ে হাঁটা যায় না। সেখানে কয়েক কোটি লোক বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। তাঁরা থাকতে চায় একটু ভালো পরিবেশে। তাঁদের ভোট পেতে হলে পরিবেশ উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বলতে হবে। এই দুর্দশা ই রাজনীতিতে নদী আন্দোলনের ভূমিকা বাড়িয়েছে এবং অন্য কথায় বললে বলতে হয় খুব শক্তিশালী অনুঘটক হয়ে উঠেছে।

বামপন্থী দলগুলো নদী রক্ষা করতে পারলে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ও প্রাকৃতিক সম্পদে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়-এই ধারণা থেকে এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে থাকে। তাঁরা মনে করেন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে যেতে চাইলে নদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকতে পারলে ভালো হয়। এটা আশির দশক থেকেই ব্যাপ্তি লাভ করে। তাঁর আগে জলা যার, মাছ তার আন্দোলন ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এ সব আন্দোলনের ভূমিকা ছিল যাতে রাজনীতি ছিল গতানুগতিক ভাবে। বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন প্রথম থেকেই ভেবে এসেছিল যে যেহেতু সব মানুষের অধিকার রক্ষায় সব মানুষের আন্দোলন। তাই কোনও একটি দলের নয়, সব মানুষের এই আন্দোলন। সেই চরিত্র এখন পর্যন্ত বজায় আছে। কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন আমরা শুরু করলেও বামপন্থী ধারার নেতৃত্ব এগিয়ে আসাকে আমরা স্বাগত জানিয়ে ছিলাম। এবং আন্দোলনটি সর্বমহলের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সরকার দাবি মানার ঘোষণা দিয়ে কপোতাক্ষ খননের কাজে হাত দিয়েছিল, কিন্তু সঠিকভাবে খননের অভাবে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এতে সেই ক্ষমতাসীনরা রাজনীতি ঘোলা করতে দেয়নি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তিস্তা রক্ষা আন্দোলন করে সরাসরি রাজনীতিতে নদী আন্দোলনের প্রভাবকে জাতীয় পর্যায়ে বহুল দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। এর মধ্য দিয়ে নদী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্পর্শ করতে সক্ষম হল। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে নদী রক্ষার পক্ষের বক্তব্য গুলো এতো জোরে উচ্চারিত হয়েছে তা বিশাল অর্জন বলে নদী আন্দোলনের নেতারা মনে করলে অত্যুক্তি হবে না। এই দাবি আদায়ের আন্দোলন মাঠেপথে সরাসরি স্থানীয় রাজনীতিতে মূল উদ্দেশ্য হাসিলের সঠিক উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জনমানুষের প্রাণের দাবি সাংস্কৃতিক বলয়ে ঘুরপাক খেলেও এই কর্মসূচি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পর্যবসিত হওয়ায় আন্দোলন- নারীদের ধন্যবাদ জানাতে হয়।

রাজনীতিতে যে রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে তাতেও নদী একটি মনোযোগের আধার হিসেবে আবির্ভূত হওয়াটা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। কেননা নদী ভরাটের পর যে জমি পাওয়া যায় তার মূল্য আকাশচুম্বী। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে নদীর জমি পাওয়াটা খুবই লাভজনক। এই লাভ এবং লোভ নদী দখলের অন্যতম কারণ। এই সব দখলের ক্ষেত্রে আদালতের রায় ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতেও লোভী প্রভাবশালীরা দ্বিধা করে না। রাজনীতি, লোভ ও মুনাফা চক্রাকারে শুধু নদীকে নষ্ট করছে না, দেশের বাজেটীয় অর্থনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিভিন্ন সময় স্থান কাল বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। আমাদের সমাজে রাস্তা বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে, নতুবা গাড়ি বাড়ি পর্যন্ত যাওয়াটাকে মর্যাদার মনে করা হতো। এ অবস্থার পরিবর্তন করে বাড়ি পর্যন্ত যাতে স্পীড বোটে যাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা রাখার নীতি অনুসরণ করতে রাজনীতিবিদরা গৌরবের মনে করবেন এবং জনগণ সেই দাবি তুলবে, সেই দিন আর বেশি দূরে নয়। নদী আন্দোলনের জয় হোক।

বাংলাদেশ নদীর জালে বেষ্টিত থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করার জন্য পানি পাওয়া যায় না। তখন মাটির নীচ থেকে পাম্প করে ফসলের ক্ষেতে পানি দিতে হয়। পাম্প চালানোর জন্য বিদ্যুৎ এর প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করা একটি আত্মঘাতী ব্যবস্থা। ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করার বিকল্প ভূ-তলের পানি ব্যবহার কোনও ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। উজান থেকে পানি আনার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের উপর নির্ভরশীলতার বিকল্প খুঁজতে হবে। এসব ঘিরে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নদী আন্দোলনের একটি বলয় তৈরি হয়েছে যার থেকে মুখ সরিয়ে কোন রাজনীতি বাংলাদেশে সফল হতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *