ePaper

নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঈদ বাণিজ্য

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক:

ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে দেশে বাণিজ্য হয় কমবেশি পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার। গত কয়েক বছরে দোকান মালিক সমিতির হিসাব বলছে এমনই। এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় এবার কমবে। তবে বেচাকেনা একেবারে খুব কম হবে এমনটিও নয়।এবার ঈদের বেচাকেনা কেমন- এ প্রশ্নের জবাব একেক ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে একেক রকম। কেউ বলছেন ভালো, কেউ বলছেন খুব খারাপ। কেউ আবার জমজমাট বেচাকেনা করেছেন, কেউ আছেন শেষ মুহূর্তে ভালো কিছুর অপেক্ষায়।১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া সবশেষ তথ্য বলছে, ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি বেড়েছে। চলতি (মার্চ) মাসের ১৯ দিনে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ২৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার বেশি।এই ১৯ দিনের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১২ কোটি ডলার বা এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মার্চে প্রবাসী আয়ে নতুন রেডর্ক সৃষ্টি হতে পারে।ঈদ কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া বইছে। বিগত কয়েক মাসের চেয়ে এখন অর্থ প্রবাহ অনেক বেশি। এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য একটি ভালো লক্ষণ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ঈদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে অনেকটা সহায়ক হবে। তবে ঈদকেন্দ্রিক অনেক ব্যয় এবার সংকোচন হবে বেশ কিছু কারণে। যার প্রভাব পড়তে পারে ঈদের টোটাল বাণিজ্যে।রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। এবছর ঈদে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়া কমবে। গাড়ি-দামি আসবাবপত্র কেনার মতো ব্যয়, যা আগের ঈদগুলোতে লক্ষ্য করা যেত, সেটা হয়তো কম হবে।- সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমঈদের এ অর্থনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে এখন খুব স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি নেই। আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির বৃত্তে আছি, যে কারণে নিত্যদিনের ব্যয় মেটানো সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর। ফলে অন্য বছরের তুলনায় ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় কম হবে, সেটা অনুমান করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আয় বাড়েনি। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে পোশাক থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে। যে কারণে মানুষ ব্যয় সমন্বয় করতে হিমশিম খাচ্ছে।’

এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। এবছর ঈদে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়া কমবে। গাড়ি-দামি আসবাবপত্র কেনার মতো ব্যয়, যা আগের ঈদগুলোতে লক্ষ্য করা যেত, সেটা হয়তো কম হবে।’এরপরও কেনাবেচা যে থেমে রয়েছে তা কিন্তু নয়। ঈদ যত কাছে আসছে, দোকানপাট ও বিপণি-বিতানগুলোতে ভিড় বাড়ছে। পোশাক, জুতা, ইলেকট্রনিক পণ্য, এমনকি ঈদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়ও বৈচিত্র্য এসেছে। আবার অনলাইনে ব্যবসা (ই-বিজনেস) বেড়েছে, দেশে-বিদেশে ভ্রমণেও যাচ্ছেন অনেকে।ঈদে অর্থের প্রবাহ কেমন থাকে এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। কিছু অনুমান করার মতো সমীক্ষা থাকলেও তা পুরোনো। তবে ঈদের অর্থনীতির আকার যাই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। কারণ ঈদ ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটায় শহর ও গ্রামে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির বড় অংশজুড়েই পোশাকের রাজত্ব। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির করা একটি জরিপে দেখা যায়, ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ব্যবসা হয় প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে পোশাক খাতে খরচ হয় ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নামাজের টুপি থেকে শুরু করে দুধ, চিনি ও আনুষঙ্গিক প্রায় সবকিছুর পেছনেও অনেক টাকা খরচ হয়।অন্য বছরের মতো এবছরও প্রতিটি পোশাক ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিয়েছেন ঈদের জন্য। এবছর ভারতের বাজার বন্ধ থাকায়, অর্থাৎ কেনাকাটার জন্য ভারত যেতে না পারায় বড় ক্রেতারা দেশের মার্কেটে আছেন।- রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস

ঈদের সময় সেমাই, চিনি, সুগন্ধি চালসহ এমন নানা পণ্যের পেছনে মানুষ খরচ করে। ফিতরা, জাকাত, দান-খয়রাত, উপহার দিতে প্রচুর ব্যয় হয়। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে প্রায় চার-পাঁচ কোটি মানুষ যাতায়াত করে। পরিবহন খাত সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় এ সময়।সাধারণত ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স আসা তুলনামূলক বাড়ে। সবকিছু ঈদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়তা করে।

ঈদ ও পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করেই মূলত দেশে গড়ে উঠেছে ফ্যাশন হাউজকেন্দ্রিক দেশীয় পোশাকশিল্প। দেশে পাঁচ হাজারের বেশি ফ্যাশন হাউজ আছে। এর বেশির ভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ফ্যাশন হাউজগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ফ্যাশন হাউজগুলোতে বছরে আনুমানিক আট হাজার কোটি টাকার পোশাক বেচাকেনা হয়। সারা বছর তাদের যে ব্যবসা হয়, তার অর্ধেকই হয় রোজার ঈদে।

এসব বিষয়ে ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠনটির পরিচালক এবং রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্য বছরের মতো এবছরও প্রতিটি পোশাক ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিয়েছেন ঈদের জন্য। এবছর ভারতের বাজার বন্ধ থাকায়, অর্থাৎ কেনাকাটার জন্য ভারত যেতে না পারায় বড় ক্রেতারা দেশের মার্কেটে আছেন।’তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রি বাড়ছে। এবারও বিক্রি হচ্ছে। যদিও শুরুতে বেচাবিক্রি কম হলেও ১৫ রোজার পর থেকে বিক্রি অনেক বেড়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবছর বেচাকেনা অন্য বছরের মতোই হবে।’ফরচুনের প্রিয় শাড়ি গ্যালারির এনামুল হক বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেড়েছে। পোশাকের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। আবার দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবার ঈদের বাজারেও প্রভাব ফেলছে। যে কারণে বিক্রি কমেছে।’আগে যেমন এক শ্রেণির মানুষ হাত খুলে খরচ করেছে, তারা এখন নেই। এখন আবার নতুন নতুন ক্রেতা আসছে। কাস্টমারের বেজ চেঞ্জ হচ্ছে। যে কারণে বিক্রি মিশ্র মনে হচ্ছে।- কেক্র্যাফটের জামিউল হককেক্র্যাফটের জামিউল হক বলেন, ‘আগে যেমন এক শ্রেণির মানুষ হাত খুলে খরচ করেছে, তারা এখন নেই। এখন আবার নতুন নতুন ক্রেতা আসছে। কাস্টমারের বেজ চেঞ্জ হচ্ছে। যে কারণে বিক্রি মিশ্র মনে হচ্ছে।’নিউ স্বর্ণদ্বীপ জুয়েলার্সের নয়ন হোসেন বলেন, ‘মানুষ সংসারের সব খরচ মিটিয়ে তারপর সোনা কেনে। একদিকে মানুষের হাতে সেই টাকা নেই, অন্যদিকে সোনার দাম বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে বিক্রি খুব কম।’মৌচাকের আয়েশা কমপ্লেক্সে তুলি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘এ ঈদে (ঈদুল ফিতর) পাঞ্জাবির কাটতি খুব ভালো থাকে। সময় যত এগোচ্ছে, ক্রেতার চাপ তত বাড়ছে। কেনাবেচা ভালো।’জুম কসমেটিকসের বিক্রেতা চন্দন হক বলেন, ‘রোজার শেষ অংশে প্রতিদিন আগে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। সেখানে এখন ৮-১০ হাজার টাকার বিক্রি করতে পারছি না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ।’সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট, শাড়ি-লুঙ্গির কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড়ের সম্ভার ইসলামপুর এখন দেশের বৃহত্তম কাপড়ের বাজার। ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির নিবন্ধিত ছোট-বড় দোকানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এর বাইরে আছে আরও দুই হাজার ছোট-মাঝারি দোকান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইসলামপুরে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ কোটি টাকার কাপড়ের ব্যবসা হয়। ঈদের আগে কখনো কখনো তা শতকোটি টাকায়ও গিয়ে ঠেকে। এবছরও ঈদের শেষ মুহূর্তে বিক্রি বাড়বে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *