ePaper

বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ৫৬ মাসে সর্বনিম্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডলার সরবরাহের উন্নতি হওয়ায় দ্রুত দেশের বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমে আসছে। গত আগস্ট শেষে এ ধরনের ঋণের স্থিতি ছিল ৯৫৫ কোটি ডলারে। গত ৫৬ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। করোনার পর ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বল্পমেয়াদি এই বিদেশি ঋণ ছিল ৯১৯ কোটি ডলার। এর পর থেকে বাড়ছিল। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২০২০ ও ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে আসে। চাহিদা কম থাকায় তখন বৈশ্বিক সুদহার অনেক কমে যায়। তবে করোনার প্রভাব কমে আসার পর সুদহার দ্রুত বাড়তে শুরু করে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। আবার টাকার বিপরীতে ডলারের দর অনেক বেড়ে যায়। এতে ঋণ পরিশোধ না করে বারবার সময় বাড়াতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। মূলত মূলধনি পণ্য ও শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির জন্য এ ধরনের ঋণ নেন ব্যবসায়ীরা।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়ে ২০২১ সাল শেষে এক হাজার ৫৪৬ কোটি ডলার হয়। পরের বছর শেষে আরও বেড়ে এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলারে ঠেকে। তবে পরে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ায় ২০২৩ সাল শেষে এক হাজার ১৭৯ কোটি ডলারে নামে। ২০২৪ সাল শেষে আরও কমে এক হাজার ১৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ঋণস্থিতি কমে গত জানুয়ারিতে ৯৮০ কোটি ডলারে নেমে যায়। ফেব্রুয়ারিতে সামান্য বেড়ে এক হাজার চার কোটি ডলার হয়। গত জুলাই পর্যন্ত প্রতি মাসেই এক হাজার কোটি ডলারের ওপরে ছিল। আগস্ট শেষে এর নিচে নামল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ২০২০ সালে ৮৪ টাকা দরের ডলার বাড়তে বাড়তে ১২৫ টাকায় ওঠে। গত বছর সরকার পতনের পর থেকে ১২১ থেকে ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে। ডলার পেতে এখন আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যে কারণে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতায় ডলারের বাড়তি দরে পরিশোধ করতে এক ধরনের শিক্ষা হয়েছে। যে কারণে এখন আর আগের মতো অনেকে ঋণ নিচ্ছেন না। তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে কম সুদের মেয়াদি ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বস্তি রয়েছে।মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমতির দিকে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, বিশ্ববাজারে সুদহারে অস্থিরতা ছিল। যে কারণে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আবার আকস্মিক সরকার পতনের পর এ ধরনের ঋণ যারা দেয়, তারাও সতর্কতা অবলম্বন করে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমেছে।দেশের স্বল্পমেয়াদি ঋণের বড় অংশই বেসরকারি খাতের। এর বাইরে পেট্রোবাংলা, রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন, চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের মতো সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানও স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকে। তবে সেটি আলাদাভাবে হিসাব করা হয়। মূলত বিভিন্ন পণ্য আমদানির বিপরীতে এলসি দায় পরিশোধের জন্য এ ধরনের ঋণ নেওয়া হয়।স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমলেও সামগ্রিকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক বেড়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুধু গত জুন মাসে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে করে জুন শেষে বিদেশি ঋণস্থিতি বেড়ে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ২১৫ কোটি ডলার হয়েছে। তিন মাস আগের তুলনায় যা ৭৩৫ কোটি ডলার বা ৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেশি। মূলত এই ঋণ বেড়েছে সরকারি খাতে। গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ তিন মাস আগের ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন থেকে কমে ১৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আর সরকারি খাতে তিন মাস আগের আট হাজার ৪৯২ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৯ হাজার ২৩৮ কোটি ডলার হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়ছে। আরেকদিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে পাচার হচ্ছে কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে, যা প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। আবার চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত এসেছে আরও ৯০২ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৬ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে ৩১ মাস পর গত সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে ২০২১ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে নামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *