ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি
পদ্মায় বালু উত্তোলন ও নৌ চ্যানেলের খাজনা আদায়ে ইজারাদারদের দ্বন্দ্বে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদীর পদ্মাপাড়ের কয়েকটি গ্রাম। দিনদুপুরে ফিল্মি স্টাইলে চলছে অস্ত্রের মহড়া, গোলাগুলি, সংঘর্ষ। সম্প্রতি পদ্মাপাড়ে বন্দুকধারীদের হামলায় দুই যুবক গুলিবিদ্ধ হন। প্রায় দিনই নদী তীরবর্তী এলাকায় শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ। সংঘর্ষের ঘটনা নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্থানীয়রা। ৬ অক্টোবর দুপুরে ঈশ্বরদীর সাঁড়া ক্যানেল পাড়ায় অতর্কিত হামলা করে গোয়ালন্দ পাকশী নৌ চ্যানেলের ইজারাদার গ্রুপ অন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেডের সহকারী পরিচালক খন্দকার সোহেলের সশস্ত্র বাহিনী। সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া গুলিতে নিজ বাড়ির সামনেই গুলিবিদ্ধ হন নিজাম ও সজীব নামের গ্রামের সাধারণ দুই যুবক। টিনের বেড়া ভেদ করে গুলি ঢোকে ঘরেও। চিরচেনা শান্তিপ্রিয় গ্রামে এমন নজিরবিহীন ঘটনায় আতঙ্ক কাটছে না গ্রামবাসীর। স্থানীয়রা বলছেন, টানা কয়েক মাস ধরে পদ্মার বালুমহাল দখল ও নৌপথে টোল আদায় নিয়ে সীমান্তবর্তী তিন জেলা নাটোরের লালপুরের কাকন আলী, কুষ্টিয়ার সোহেল খন্দকার ও ঈশ্বরদীর এটি এন্টারপ্রাইজের মেহেদি হাসানের দ্বন্দ্ব চলছে। আধিপত্য বিস্তারের এ লড়াইয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মহড়া ও দফায় দফায় হামলা, সংঘাতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পাকশী ও সাঁড়া ইউনিয়নের পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলোতে। প্রশাসনের অভিযানের পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন গ্রামবাসী। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। নদীতে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যেতেও ভয় পাচ্ছেন জেলেরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত কয়েক মাসে পদ্মাপাড়ে বালুর নিয়ন্ত্রণ ও চ্যানেলের খাজনা আদায় নিয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় এখানকার মানুষজন আতঙ্কিত। ৬ অক্টোবর সাঁড়া চ্যানেল পাড়ায় দুজন ও ২২ মে সাঁড়ায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া প্রায়ই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সবশেষ সোমবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলির শব্দে পদ্মাপাড়ের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এসব ঘটনায় প্রশাসনও একাধিবার পদ্মায় অভিযান চালিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে ১৭ জুলাই তিনটি পিস্তল, গুলি, মাথার খুলি ও নগদ ১২ লাখ টাকাসহ দুজনকে আটক করে যৌথবাহিনী। পদ্মা নদীর দিয়াড় বাহাদুরপুর মোল্লা ট্রেডার্সের বালু মহালে এ অভিযান পরিচালিত হয়। সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ দিনব্যাপী অভিযানে মহাল থেকে মাহফুজুর রহমান সোহাগ ও আশরাফুল ইসলাম বাপ্পি নামে দুজনকে আটক করে। ২৯ সেপ্টেম্বর ছয়জন ও ৪ অক্টোবর পাঁচজনকে অবৈধভাবে সাঁড়া ঘাট এলাকায় বালু উত্তোলনের অভিযোগে আটক করে পুলিশ। সাঁড়ায় গুলিবিদ্ধ সজিবের মা ফাহিমা খাতুন জানান, বাড়ির সামনেই গুলিবিদ্ধ হন সজিব ও নিজাম। সন্ত্রাসীরা নৌকা থেকে তাদের গুলি করে। আহত দুজন বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন। সাঁড়া ঘাট এলাকার জেলে সুবল দাস বলেন, ‘নদীতে এখন নৌকা নিয়ে যাইতে ভয় লাগে। ৫-৬ মাস হলো নদীতে যেভাবে গোলাগুলি, অস্ত্রের মহড়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, এতে আমরা আতঙ্কিত। ভয়ে আমরা ঠিকমতো মাছ ধরতে যেতে পারছি না।’ নদীপাড়ের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ বলেন, ‘পদ্মাপাড়ে এখন মাঝেমধ্যেই গুলির শব্দ শোনা যায়। বালুমহালের আধিপত্য, নৌ চ্যানেলের খাজনা আদায় নিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হচ্ছে। এসব বিষয়ে প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।’ এ বিষয়ে এটি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মেহেদি হাসানের অভিযোগ, ইজারার সীমানা অতিক্রম করে জোরপূর্বক টোল আদায়ে বাধা দেওয়ায় সশস্ত্র আক্রমণ করছে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। সব জেনেও অজ্ঞাত কারণে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন। বক্তব্য জানতে সোহেল খন্দকার ও কাকন আলীর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ঈশ্বরদীর লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নদীতে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। কোনো ধরনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ এ বিষয়ে ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ স ম আব্দুন নূর বলেন, নদীতে দায়িত্ব পালন করে নৌ পুলিশ। তাদের সব বিষয়ে দেখভাল করার কথা। তবে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থানা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
