প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করা হয়েছে আজীবন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু এর পরিবেশগত ক্ষতি এখন একটি বৈশ্বিক সংকট। এই সংকটের সমাধান খুঁজতে গিয়ে জাপানের কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল সৃজনশীল বিজ্ঞানী একটি যুগান্তকারী সাফল্য এনেছেন। তারা ব্যাকটেরিয়াকে একটি ক্ষুদ্র কারখানায় রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ জৈব-পচনযোগ্য একটি প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করেছেন, যা শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।
এই গবেষণা, যা প্রখ্যাত জার্নাল ‘মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ প্রকাশিত হয়েছে, এটি শুধু একটি নতুন উপাদানই উপস্থাপন করেনি, বরং প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার পদ্ধতিকেই পুনর্বিবেচনা করেছে। তাদের তৈরি করা উপাদানটির নাম পাইরিডিনেডিকারবক্সিলিক অ্যাসিড (পিডিসিএ), এবং এটি প্রচলিত প্লাস্টিকের একটি প্রধান ক্ষতিকর উপাদানকে প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে।
২. পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার চ্যালেঞ্জ
ঐতিহ্যগতভাবে, প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করা হয় জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে, যা কার্বন নিঃসরণ বাড়ায় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত বর্জ্য সৃষ্টি করে। প্রচলিত পদ্ধতিতে পিডিসিএ এর মতো প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করতেও একই রকম পরিবেশ-বিধ্বংসী পদ্ধতি অনুসরণ করা হত, যা মূল সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
বিজ্ঞানীরা এই চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করার জন্য একটি জৈব-ভিত্তিক পদ্ধতির দিকে ঝুঁকেছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা যেখানে প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার সময় কোনো বিষাক্ত উপজাত (বাই-প্রোডাক্ট) না তৈরি হয় এবং যা সম্পূর্ণরূপে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে। এই লক্ষ্যেই তারা তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রকৃতির সবচেয়ে ক্ষুদ্র ও দক্ষ রসায়নবিদ—ব্যাকটেরিয়ার উপর।
৩. ব্যাকটেরিয়া দিয়ে প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার গোপন রহস্য
কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দল, যার নেতৃত্বে আছেন ড. তানাকা সুতোমু, ইকোলি (E. coli) ব্যাকটেরিয়ার জিনগত কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার মাধ্যমে এই যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা ব্যাকটেরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিপাকীয় পথ (মেটাবলিক পাথওয়ে)কে পুনঃনির্দেশিত করেছে যাতে এটি নাইট্রোজেন শোষণ করে এবং তা ব্যবহার করে মূল্যবান পিডিসিএ প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করতে পারে।
এই প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত জটিল। প্রাথমিকভাবে, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একটি নতুন ধরনের ক্ষতিকারক উপজাতের সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু দলটি অধ্যবসায়ের সাথে কাজ চালিয়ে যায় এবং একটি বিশেষায়িত জৈব-প্রকৌশল কৌশল অবলম্বন করে। এই কৌশলটি কেবল বিষাক্ত বর্জ্যকেই শূন্যে নামিয়ে আনে নি, বরং উৎপাদনের হারকে আগের পদ্ধতির তুলনায় সাত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। ড. তানাকা তার গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “আমরা একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। নাইট্রোজেনকে শোষণ করার জন্য কোষীয় বিপাক কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা আমরা লক্ষ করেছিলাম। আমাদের সাফল্য এই ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে।”
এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করা শিল্পখাতের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে। আপনি মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নালের ওয়েবসাইট থেকে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি পড়তে পারেন।

৪. নতুন পদ্ধতিতে প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার সুবিধা
এই নতুন পদ্ধতিতে প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা রয়েছে:
- জৈব-পচনযোগ্যতা: পিডিসিএ একটি নাইট্রোজেন-ভিত্তিক যৌগ, যা এটিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজেই এবং দ্রুত ভাঙ্গার ক্ষমতা দেয়, ফলে এটি মাটি বা জলে জমে থাকবে না।
- বিষমুক্ত উৎপাদন: পুরো উৎপাদন চক্র জুড়ে কোনও বিষাক্ত রাসায়নিক উপজাত তৈরি হয় না, যা এটি একটি সবুজ ও টেকসই প্রক্রিয়া করে তোলে।
- উচ্চ দক্ষতা: উৎপাদন হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
- প্রতিস্থাপনের ক্ষমতা: এই নতুন প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করা হয়েছে বিশেষভাবে পিইটি (PET) প্লাস্টিকের ক্ষতিকর টেরেফথালিক অ্যাসিডের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য, যা পানির বোতল এবং প্যাকেজিং সামগ্রীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্লাস্টিক ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায় কেন এই ধরনের উদ্ভাবন এত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি: সবুজ শিল্পের রূপান্তর
যদিও এই প্রযুক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, এর সম্ভাবনা অপরিসীম। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এই গবেষণা প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার ক্ষেত্রে আরও অনেক উদ্ভাবনের পথ প্রশস্ত করবে। ভবিষ্যতে, আমরা দেখতে পারি ব্যাকটেরিয়া শুধু পিডিসিএ নয়, বরং আরও অনেক ধরনের জটিল ও টেকসই বায়োপলিমার উৎপাদন করছে।
এই ধরনের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের সংকট মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির (Circular Economy) দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে। এটি শিল্পখাতকে পেট্রোলিয়াম-ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে জৈব-ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
৬. সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
প্রশ্ন: এই নতুন প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করা হয়েছে কি সম্পূর্ণরূপে প্লাস্টিকের বিকল্প?
উত্তর: না, এটি বর্তমানে প্লাস্টিকের একটি সম্পূর্ণ বিকল্প নয়, বরং এটি নির্দিষ্ট ধরনের প্লাস্টিকের (যেমন পিইটি) ক্ষতিকর উপাদানগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম।
প্রশ্ন: এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করা কি বাণিজ্যিকভাবে সম্ভব?
উত্তর: গবেষণাটি এখনও ল্যাব পর্যায়ে আছে, কিন্তু উৎপাদন হার সাত গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি বাণিজ্যিকীকরণের পথে একটি বড় সাফল্য। আরও গবেষণা ও বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।
প্রশ্ন: এই বায়োপ্লাস্টিক রিসাইকেল করা যাবে কি?
উত্তর: যেহেতু এটি জৈব-পচনযোগ্য, তাই এটি প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজে分解 হয়। তবে, এর রিসাইক্লিং প্রবাহ নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন।
