নিজস্ব প্রতিবেদক
মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজিতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। তাতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। মূলত অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এবং সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে বিপাকে পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ। তাছাড়া পণ্যের দাম বাড়ার জন্য সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজিও অনেকাংশে দায়ী। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে কখনোই দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল হবে না। বাজার এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সম্প্রাতিক সময়ে খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি তদন্ত করতে সরকারের একটি গোয়েন্দ সংস্থা দেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকারী জেলা ও বন্দর থেকে ঢাকার বাজার পর্যন্ত অনুসন্ধান চালায়। ওই অনুসন্ধানে সবজির জন্য বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার নিমসার, নরসিংদীর জংলী বাজার ও যশোরের সাতমাইল; চালের জন্য দিনাজপুর, শেরপুর ও নওগাঁ; দেশি পেঁয়াজের জন্য পাবনা এবং আমদানিকৃত পণ্যের জন্য চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও যশোরের বেনাপোল থেকে পণ্যবাহী ট্রাকে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরা যাত্রীবেশে ঢাকার বিভিন্ন বাজার পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে। তাতে সংগ্রহ করা হয়েছে কৃষকের উৎপাদনমূল্য, স্থানীয় বাজারদর, পরিবহন খরচ, ঢাকা আড়তের পাইকারি দাম, প্যাকেজিং, শ্রম, কমিশন এবং চাঁদাবাজি-সংক্রান্ত তথ্য। আর ওই অনুসন্ধানে সড়ক-মহাসড়কে প্রত্যক্ষভাবে চাঁদাবাজির প্রমাণ না মিললেও তথ্য পাওয়া গেছে ট্রাক ভাড়া নিতে স্ট্যান্ডে নানা ধরনের দালালির। সাধারণ মানুষ বাজারে খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। মধ্যস্বত্বভোগী চক্র মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বরং আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। আর বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সাধারণ মানুষ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সূত্র জানায়, অনুমোদিত ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ মাল অধিকাংশ ট্রাক বহন করে। তাতে সিটি করপোরেশনের চাঁদা, পার্কিং ফি বা মালিক-শ্রমিক সমিতির চাঁদা খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দামে বড় প্রভাব পড়ার কথা নয়। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ানোর মূল কারণ। তাদের কারণেই খুচরা বাজারে পণ্যের দাম দ্বিগুণ, এমনকি তিন গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ওই চক্র বছরের পর বছর উৎপাদনকারী ও ভোক্তাদের বঞ্চিত করে লুটছে মুনাফা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সবজি, চাল, ডাল ও পেঁয়াজ আনতে হলে পথে পথে নানা নামে চাঁদা দিতে হয় আট জায়গায়। ওই চাঁদার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও দ্রব্যের দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে চাঁদাবাজিকেই বেশি দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। মূলত নিজেদের কারসাজি ঢাকতেই এ অজুহাত দেখানো হয়। বরং ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে অনেক সময় খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে দামের পার্থক্য কিছু ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। সূত্র আরো জানায়, খাদ্যপণ্যবাহী প্রতি ট্রাক কারওয়ান বাজারে প্রবেশ করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দিতে হয় ১০০ টাকা। ট্রাক পার্কিং খরচ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। বাজার খাজনা ৪০০ টাকা। ট্রাকের দালালরা নেয় এক হাজার টাকা। ট্রাক শ্রমিক সমিতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা, ট্রাক মালিক সমিতি ৫০ টাকা, বাজার কমিটি ১৬০ টাকা এবং সুইপার চাঁদা গাড়ি প্রতি ২০০ টাকা নেয়া হয়। তবে ঢাকার কারওয়ান বাজারে শ্রমিক, ভ্যানচালক, আড়তদার ও লাইনম্যানদের যোগসাজশে পাইকারদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা নেয়া হয়। আর দেশের প্রায় সব জেলায় সবজি উৎপাদন হলেও প্রতিটি জেলায় আড়ত না থাকায় কৃষক ও ফড়িয়াদের অন্য জেলার আড়তে গিয়ে সবজি বিক্রি করতে হয়। তাতে তাদের অতিরিক্ত খরচ হয় এবং সবজির দাম বাড়ে। এদিকে খাদ্যপণ্য সরবরাহের ১০টি রুটে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ট্রাকে যাত্রীবেশে ভ্রমণ করেছেন। তাদের ভ্রমণে সড়ক-মহাসড়কে জেলা পুলিশ বা হাইওয়ে পুলিশের কোনো ধরনের নিয়মিত চাঁদাবাজি বা অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ট্রাক মালিক সমিতির নেতাদের মতে, খাদ্যপণ্য পরিবহনের জন্য পুলিশের সঙ্গে মাসিক, সাপ্তাহিক বা দৈনিক কোনো চুক্তি নেই। যেসব ট্রাকের হালনাগাদ কাগজপত্র নেই এবং নিয়মিত অতিরিক্ত মাল বহন করে, ওই ট্রাক মালিকরাই হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ফলে কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত লাভের আশায় মামলার ভয় দেখিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে টাকা আদায় করে। গোয়েন্দাদের পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে সড়কে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, কারওয়ান বাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী এবং সিন্ডিকেটের অনিয়ম ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মনিটরিং আরো জোরদার করা এবং যেসব জেলায় সবজির উৎপাদন বেশি, সেখানে আড়ত স্থাপন করে সরবরাহ ব্যবস্থায় হাতবদল কমিয়ে দ্রব্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন জানান, মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্যই সবকিছুর দাম বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে এক গ্রুপকে চাঁদা দেয়া হলেও এখন তিনটি গ্রুপকে দিতে হয়। আর ওই গ্রুপ হচ্ছে বিএনপি, এনসিপি আর জামায়াত। আগে পরিবহনে যে চাঁদাবাজি হতো তা এখনো চলছে। পাশাপামি আড়তদার বা বেপারি কোনো উৎপাদন বা আমদানিতে জড়িত না থেকেও দাদন খাচ্ছে। এখন তারা কমিশন এজেন্টে পরিণত হয়েছে। কত টাকা দিয়ে পণ্য কিনেছে তার কোনো পাকা রসিদ থাকে না, প্রতি কেজিতে শুধু কমিশন নেয়। করপোরেট গ্রুপগুলো দাদন দিয়ে কমিশনের মাধ্যমে চাষাবাদ করাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে। তাতে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা হয় না। সেজন্য ক্যাব আলাদা ভোক্তা মন্ত্রণালয়ের দাবি তুলেছিলো। কারণ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। বাজারের এসব অনিয়ম নিত্যদিনের চিত্রে পরিণত হয়েছে এখন।
মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজিতে খাদ্যপণ্যে ভোক্তার নাভিশ্বাস
