ePaper

সিরাজগঞ্জে কাজিপুর তাড়াশের চলনবিলে পাটের সুদিন ফিরছে

রফিকুল ইসলাম,সিরাজগঞ্জ

চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জে তাড়াশের বানিয়াবহু এলাকার কৃষক লিয়াকত আলী ২ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল ২৩ হাজার টাকা। ২১ মণ পাট বিক্রি করেছেন ৭৯ হাজার টাকায়। অর্থাৎ লিয়াকতের লাভ হয়েছে ৫৬ হাজার টাকা। লিয়াকত বলেন, অন্য ফসল আবাদ করে ২ বিঘা জমিতে এ পরিমাণ লাভ পাওয়া অসম্ভব। অনেকেই এবার পাট চাষ করে লাভবান হয়েছেন। চলনবিলে সোনালি আঁশ পাটের আবাদে সুদিন ফিরতে শুরু করেছে বলে জানান এই কৃষক। ৭০-৮০-এর দশকেও নদীকেন্দ্রিক চলনবিলের পাটের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখানকার পাটবন্দরগুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের সলঙ্গা, চান্দাইকোনা, উল্লাপাড়ার ঝিকড়া বন্দর, চাচকৈড় হাট, তাড়াশের নওগাঁ, মির্জাপুর, হান্ডিয়ালসহ বেশ কিছু পাটবন্দর উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে এগুলো ছাড়াও পাবনার চাটমোহরের অমৃত কুন্ডা, মহেলা, কাটাখালী; রায়গঞ্জের পাঙ্গাশী, ঘুরকা; ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ, নাটোরের সিংড়ার বন্দর, বিয়াস হাটে হরদম চলছে পাট বেচাকেনা। সরেজমিনে তাড়াশের প্রসিদ্ধ নওগাঁ হাটে গিয়ে দেখা গেছে,  ক্রেতা, বিক্রেতা, কুলি, শ্রমিকের উপস্থিতিতে হাট সরগরম হয়ে উঠছে। বিশেষ করে নতুন পাটের আমদানি গত বছরের তুলনায় বেশি। দামও গত বছরের চেয়ে প্রকারভেদে মণপ্রতি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা বেড়েছে। এ হাটে পাট কিনতে এসেছেন গুরুদাসপুরের মহাজন আব্দুস সালাম। তিনি জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক হাটে ১৪০০ থেকে ১৫০০ মণ পাট বিক্রি হয়। চলনবিলসংলগ্ন প্রায় সব হাটেই শত শত মণ পাট বিক্রি হচ্ছে। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলনবিলে বোরো আবাদের পর পাট আবাদ করা হয়েছে। চলতি বছর এ বিলের সিরাজগঞ্জের তাড়াশ অংশে ৮১০ হেক্টর, শাহজাদপুরে ৩৮৭ হেক্টর, নাটোরের গুরুদাসপুরে ৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর, সিংড়ায় ১ হাজার ৭৪০ হেক্টর, পাবনার চাটমোহরে ৮ হাজার ৯৬০ হেক্টরসহ ৯ উপজেলায় ২২ হাজার ১০৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। ২০২৪ সালে আরও কম জমিতে পাট আবাদ হয়েছে। ওই বছর সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ৬০১ হেক্টর, শাহজাদপুরে ৩২৭ হেক্টর, নাটোরের গুরুদাসপুরে ৪ হাজার ৩৩৯ হেক্টর, সিংড়ায় ১ হাজার ৭০০ হেক্টর, পাবনার চাটমোহরে ৮ হাজার ৪৫৬ হেক্টর। চলতি মৌসুমে এর চেয়ে প্রায় ১ হাজার ১৯১ হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। এক দশক আগেও এ অঞ্চলের কৃষকরা তোষা জাতের পাটের আবাদ করতেন। পাঁচ-ছয় বছর ধরে কেনাফ, মেস্তা, রবি-১সহ কয়েকটি জাতের পাট আবাদ শুরু করেছেন তারা। বিঘায় ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১১-১২ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যাচ্ছে। উপজেলার উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তাফা জানান, ৭৫ থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে পাটের ফলন পাওয়া যায়। পাট প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয়। ধান, সরিষা, আলু বা অন্য ফসলের চেয়ে লাভজনকও বটে। এ কারণে বোরো আবাদের পর পাট রোপণ করেন কৃষকরা। নাটোরের সিংড়া উপজেলার বিয়াস এলাকার কৃষক মো. জালাল উদ্দিন জানান, এক বিঘায় পাট আবাদ করতে জমি প্রস্তুত, সার-বীজ, শ্রমিক খরচসহ সর্বসাকল্যে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। যে ফলন পাওয়া যায় তাতে অনায়াসে এক বিঘা জমির পাট ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। চলনবিলের হাট-বাজারে মেস্তা জাতের পাট বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার টাকা, তোষা ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়, কেনাফ ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকায়, রবি-১ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ১৫০ টাকায়। চলনবিলের চাচকৈড় হাটে আসা নাটোরের মহাজন সুধাংশু সরকার জানান, গত বছর চলনবিলের হাট-বাজারে পাটের দর ওঠানামার মধ্যে থাকলেও প্রতি মণ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকার বেশি ছিল না। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই প্রকারভেদে সব ধরনের পাট ২৮০০ থেকে ৪০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা গত বছরের তুলনায় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুম শেষে দাম বাড়তে পারে বলে জানান তিনি। গুরুদাসপুর কৃষি কর্মকর্তা কে এম রাফিউল ইসলাম জানান, বৃহৎ এলাকা নিয়ে চলনবিল। গুরুদাসপুরে এ বছর পাটের আবাদ গত বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। ফলনের সঙ্গে ভালো দামও পেয়েছেন কৃষক। মোট কথা, এ অঞ্চলে পাটের সুদিন ফিরেছে। তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শর্মিষ্ঠা সেনগুপ্তা জানান, পাটের এ দাম স্থায়ী হলে এ অঞ্চলে পাটের হারানো সুদিন ফিরবে। অপরদিকে কাজিপুরের ঐতিহ্যবাহী নাটুয়ারপাড়া, সোনামুখী ও ঢেকুরিয়া হাটে পাটের জমজমাট কেনাবেচা চলছে। এবছর ফলন ভালো হওয়ায় পাটের হারানো ঐতিহ্য আবারও ফিরে পেয়েছেন কৃষকরা। অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই পাটের ভালো দাম পেয়ে এ অঞ্চলের কৃষকরা প্রতি বছরেই পাটের আবাদ বাড়াচ্ছেন। আবারো পাট চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে। কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চরাঞ্চলসহ ১২ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় এ মৌসুমে চার হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে তোষা জাতের চাষ হয়েছে চার হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। মেস্তা ৭৫ এবং দেশীসহ অন্যান্য পাট চাষ হয়েছে ৭৫ হেক্টর জমিতে। ইতোমধ্যেই পাট কাটা জাগ দেওয়া ও শুকিয়ে বিক্রি শুরু হয়েছে পুরোদমে। সপ্তাহের প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার ঢেকুরিয়া, বুধ ও শনিবার নাটুয়ারপাড়া এবং রবি ও বুধবার সোনামুখী হাটে ভোর রাত (ফজরের আগ) থেকেই কেনাবেচা শুরু হয়। সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। বন্যার কারণে নাটুয়ারপাড়া হাটে কেনাবেচা হয় নৌকার ওপরে। কৃষকেরা যে নৌকা করে পাট নিয়ে আসেন সেই নৌকার কাছে পাইকারদের নৌকা ঠেকিয়ে দরদাম শুরু হয়। এরপর দাম মিটে গেলে পাইকারের লোকজন কৃষকের নৌকা থেকে পাটের বোঝাগুলো নামিয়ে নেন। তবে শুধু কাজিপুরের কৃষকরাই নন আশপাশের ধুনট, সরিষাবাড়ি, সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জ সদর থেকেও পাটবোঝাই নৌকা আসে এই হাটে। এই হাটের ক্রেতারা আসেন জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থেকে। নদীপথে পরিবহণ সুবিধা নিতেই এই হাটে কেনাবেচা হয় অনেক বেশি। এছাড়া ঢেকুরিয়া হাটও যমুনার তীরে হওয়ায় এই হাটের পাটও নৌকাবোঝাই করে নদীপথে দেশের নানাস্থানে চলে যায়। এবছর প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে রং ও প্রকারভেদে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায়। এতে উৎপাদন খরচ পুষিয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। হাটে আগত ক্রেতা-বিক্রেতা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব তথ্য। এদিকে জামালপুর থেকে পাট কিনতে আসা ব্যাপারী সলিম মিয়া জানান, সরিষাবাড়িতে আমাদের চার পুরুষের পাটের আড়তের ব্যবসা। প্রতিবার পাটের মৌসুমে আমরা তিন থেকে চার হাজার মণ পাট কিনি। পরে ঢাকায় পাঠাই। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাট কিনতে আসা সবুর ব্যাপারী জানান, ভালো এবং শুকনো পাট পেলে প্রতিহাটে ৩০/৪০ মণ পাট কিনি এই হাট থেকে। নৌকায় পাট বিক্রি করছেন মাইজবাড়ী চরের কৃষক আয়নাল হক। তিনি বলেন, ‘৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করছিলাম। ফলন ভালো হইছিলো। আজ বেচতে এসে মোটামুটি যে দাম পাইছি তাতে আমি খুশি।’ হাটের ইজারাদার আব্দুল লতিফ সরকার বলেন, এবার পাটের কেনাবেচা বেশ জমে উঠেছে। দূর দুরান্ত থেকে পাটের পাইকার আসেন। অনেকটা নিরাপদেই তারা পাট কেনন। এখানে নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই। কাজিপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, উপযুক্ত সময়ে সরকারি প্রণোদনা, মাঠে কর্মরত অফিসারদের সঠিক সময়ে পরামর্শ এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হওয়ায় এ বছর পাটের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। এ উপজেলায়  প্রতি হেক্টরে প্রায় দেড় মেট্রিকটন পাটের উৎপাদন হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *