সিলেট প্রতিনিধি
২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পট পরিবর্তনের পর সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হয়ে আসেন মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। কিন্তু তার প্রস্থানটা সুখকর হলো না। পাথর লুটপাট ঠেকাতে ব্যর্থ জেলা প্রশাসনের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তাই সমালোচনার মুখে বিতর্কিত হয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যেই সিলেট ছাড়তে হলো ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে। গতকাল বুধবার সকালে তার কার্যালয়ে বিদায়ী সংবর্ধনা দেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংবর্ধনা শেষে দুপুর ১২টার পর সরকারি গাড়িতে করে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে গানম্যানসহ বেরিয়ে যান মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। পাথর কাণ্ডে সমালোচিত হওয়ায় গত সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে মাহবুব মুরাদকে ওএসডি করা হয়। তাই সমালোচনা মাথায় নিয়ে অনেকটা নীরবে বিদায় নিতে হলো তাকে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মাহবুব মুরাদের স্থলাভিষিক্ত (নতুন নিয়োগ পাওয়া) জেলা প্রশাসক মো. সারোয়ার আলম বৃহস্পতিবার এসে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এর আগ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সূবর্ণা সরকার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন। এদিকে, মাহবুব মুরাদ সিলেটের জেলা প্রশাসক হয়ে আসার পর গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ও সাদাপাথরসহ বিভিন্ন কোয়ারি থেকে বালু ও পাথর হরিলুট করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সাদাপাথরে নজিরবিহীন পাথর লুটপাটের ঘটনায় দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর থেকেই পাথর লুটপাটে প্রশাসনের উদাসীনতা ও ব্যর্থতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরই মধ্যে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও বলেছেন, পাথর লুটে স্থানীয় প্রশাসনের দায় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরদিনই সিলেটের জেলা প্রশাসককে ওএসডি করা হয়। এর আগে সাদা পাথর পরিদর্শনে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারাও পাথর লুটে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে বলে জানান। প্রশাসনের অভিযানে উদ্ধার: সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাটের পর গত ১৩ আগস্ট বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের জরুরী বৈঠকের পর লুণ্ঠিত পাথর সাদা পাথরে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। বৈঠকের ৫ সিদ্ধান্তের একটি ছিল সাদা পাথরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং কোয়ারি এলাকায় সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী মোতায়েন। এরপর রাতেই অভিযানে নেমে ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করে যৌথবাহিনী। পরদিন বৃহস্পতিবার সাদাপাথর লুটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ২নং পুর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ওইদিন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগ এলাকা থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। এরপর শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদর, কালাইরাগসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৪৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। একই দিনে শুক্রবার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) আনোয়ারুল হাবিব বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত ১৫০০-২০০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১৬ আগস্ট ধোপাগুল স্টোন ক্রাশার মিল ও বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মজুদকৃত আড়াই লাখ ঘনফুট সাদাপাথর এবং জাফলং এলাকা থেকে লুট হওয়া পাথর জব্দ করা হয়। এ কয়েকদিনে সর্বাধিক পাথর মিলেছে ধোপাগুলে। এছাড়া সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত আনুমানিক ১১টা পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এ পাথরগুলো উদ্ধার করা হয়। এ অবস্থায় গত রোববার সামনে আসে জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর রাংপানি পর্যটন এলাকা থেকে পাথর লুট এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ায় নিলামের কাগজ ব্যবহার করে পাথর লুটেরও অভিযোগ ওঠে। পরদিন সোমবার জৈন্তাপুরে অভিযানে ৩৫ ট্রাক বালু ও সাড়ে ৯ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। এরপর মঙ্গলবার জব্দ করা হয় ২০ হাজার ফুট পাথর ও ২৮ হাজার ঘনফুট বালু। একই দিন উৎমাছড়া সংলগ্ন আদর্শ গ্রাম থেকে আরো ২ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করে বিজিবি। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত অভিযানে ৮ লাখ ৭০ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ ও প্রতিস্থাপন করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ঘনফুট। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরে ব্যাপক লুটপাট শুরু হয়। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর এক সমীক্ষায় ওই এলাকায় প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট পাথরের মজুদ ছিল বলে জানানো হয়। স্থানীয়রা বলছেন, দিনরাত পাথর লুটপাট ও পাচারের কারণে শুধু খনিজ সম্পদই নয়, ধ্বংস হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোও। ভোলাগঞ্জের ঘটনায় সমালোচনার মুখে প্রশাসন দায়সারা অভিযান চালাচ্ছে, বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। সারা দেশে ৫১টি কোয়ারি (পাথর ও বালু উত্তোলনের নির্দিষ্ট স্থান) আছে। এর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে আছে আটটি পাথর কোয়ারি। এর বাইরে সিলেটে সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়াসহ আরও ১০টি জায়গায় পাথর আছে। এসব জায়গা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড়ি নদী থেকে এসব পাথর আসে। ২০২০ সালের আগে সংরক্ষিত এলাকা বাদে সিলেটের আটটি কোয়ারি ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির কারণে ২০২০ সালের পর আর পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি। এদিকে, সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় পাথর উত্তোলনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। বিগত পাঁচ বছরে তারা নানাভাবে কোয়ারি ইজারা আবার চালুর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। এ অবস্থায় রাতের বেলা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হতো। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টানা এক বছর বেপরোয়াভাবে পাথর লুটপাট চলে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, সাদাপাথর থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পাথর লুটপাট করেছে। দিনে অন্তত ৬ হাজার নৌকা ব্যবস্থার হয়েছে লুটপাটে। প্রতি নৌকার সঙ্গে অন্তত ১০-১২ জন লোক ছিলেন। পুরো সাদা পাথর এলাকা থেকে হাজার কোটি টাকার পাথর লুটের দাবি করেছিলেন দুদকের এ কর্মকর্তা। এছাড়া লুটপাটের ঘটনায় প্রশাসনের দায় দেখছেন, বলেও উল্লেখ করেন।
