ePaper

সুন্দরবনের উপকূলে বাগেরহাটেই কাঁকড়া রফতানি আয় বছরে এক কোটি ডলার!    

                                                                                                        

এস. এম সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে :দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূলে বিদেশে রপ্তানি করা মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ির পরই সম্ভাবনাময় কাঁকড়া। দেশে যেসব জেলায় কাঁকড়া উৎপাদিত হয় তার মধ্যে অন্যতম বাগেরহাট। কাঁকড়া পানি ছাড়াও ছয় ঘণ্টার মতো বেঁচে থাকতে পারে। কাঁকড়ার রোগ কম হয় এবং মরেও কম। কিন্তু চিংড়ির ঘেরে একবার রোগ ছড়িয়ে পড়লে সবগুলো মারা যায়। তাই লাভজনক হওয়ায় অনেকে চিংড়ি ছেড়ে কাঁকড়া চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ ও রফতানি হচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে। এখানে বছরে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে নরম কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ৫৬৭ মেট্রিক টন, যার মূল্য ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ৫১৮ মেট্রিক টন, যার রফতানি মূল্য ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ডলার। ২০২১-২২ সালে রফতানি হয় ৮০২ মেট্রিক টন, যার রফতানি মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ ৫১ হাজার ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৬২২ মেট্রিক টন, যার রফতানি মূল্য ৮৬ লাখ ৯৮৪ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৩ মেট্রিক ?টন কাঁকড়া যার উৎপাদনায় হয় এক কোটি ৯৯৮ডলার ২০২৪ ২৫ অর্থবছরে ৯৮১ মেট্রিক টন কাকড়া উৎপাদন হয় যা থেকে হায় হায় ১ কোটি ২০ লক্ষ ডলার।সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সুন্দরবন নির্ভরতা কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে হ্যাচারিতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে। সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার লোনা পানিতে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি সফটসেল কাঁকড়া চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে উপকূলীয় এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার সফটসেল কাঁকড়ার খামার। তবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুমের কারণে প্রতি বছর ৫ মাসের বেশি সময় সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণের পাস বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন চাষিরা। জেলার সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ৩২০ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার চাষ হয়ে থাকে। সেখানে গত অর্থবছরে দুই হাজার মেট্রিক টন সফটসেল’ কাঁকড়া ও হার্ডসেল কাঁকড়া উৎপাদন হয়। এর মধ্যে জীবন্ত হার্ডসেল কাঁকড়া ও সঙ্গে সঙ্গে সফটসেল কাঁকড়ার সবই বিদেশে রফতানি করে অর্জিত হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

কাঁকড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প উপায়ে স্বল্পমূল্যে কাঁকড়ার পোনা সরবরাহের পাশাপাশি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবি চাষিদের।

তারা জানান, অল্প জমিতে কাঁকড়া চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছেন তারা। কাঁকড়ার চাষ করে তাদের সংসারে সফলতা এসেছে। ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে তারা লেখাপড়া শেখাতে পারছেন। তাই কাঁকড়া চাষে তাদের আগ্রহ বেশি। কাঁকড়া চাষে দরিদ্র জনগোষ্ঠী জড়িত উল্লেখ করে বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস জানান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে হ্যাচারিতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদন প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে, তেমনি কর্মসংস্থান বাড়বে। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দক্ষিণঅঞ্চল থেকে ৬২২ দশমিক শূন্য ৫ মেট্রিক টন কাকড়া রপ্তানি হয়েছে। যার দাম ৭৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে সংগ্রহ করা ১৯৮ মেট্রিক টন। বাকি ৩৫৮ মেট্রিক টন চাষের। কাঁকড়া চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। জেলার ৭ উপজেলায় ১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে তিন হাজার ৭৭৮ কাঁকড়ার খামার রয়েছে। উৎপাদন প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন। ফিমেল (নারী) কাঁকড়া প্রতি কেজি ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর মেল (পুরুষ) ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাসে কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-জুন) এ রপ্তানি ছিল ৯ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এতে বিগত বছরে চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু চলতি বছরের জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার কাঁকড়া চাষ করেন আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই আমাদের অর্থনৈতিক একটা ঝুঁকি সব সময় থাকে। চিংড়ি পোনার লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং পোনায় ভাইরাসের আক্রমণে এটি মারা যায়। তাই আমি কয়েক বছর ধরে কাঁকড়া চাষ করেছি। তিনি আরও বলেন, এতে তুলনামূলক লাভ বেশি হয় ও কাঁকড়ার পাশাপাশি পুকুরে সাদা মাছ চাষ করছি, যাতে এটি থেকেও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া যায়। চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, তিন মাস সময়ের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা জাতের কাঁকড়া রপ্তানিযোগ্য হয়। শৈত্যপ্রবাহ ও গ্রীষ্মের দাবদাহে কাঁকড়া মারা যায় না। স্বল্প সময়ে বেশি মুনাফা হওয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ৪ লাখ ডলার মূল্যের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। রামপাল উপজেলার কুমলাই গ্রামের কাঁকড়া চাষি মিলন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘প্রায় বিশ বছর ধরে কাকড়া চাষ করছি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ঘের ক্ষতিগ্রস্ত ও করোনার দুই বছর রপ্তানি বন্ধ থাকায় লোকসানে পড়তে হয়। এবার সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি।’বাইনতলা গ্রামের শুকুর আলী বলেন, ‘একসময়ে চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভর ছিলাম। তবে ভাইরাসের কারণে লোকসানে পড়তে হয়েছে। এরপর কাঁকড়া চাষ শুরু করি। রোগবালাই না হওয়ায় স্বল্প সময়ে কাঁকড়া চাষে লাভবান হওয়া যায়। বাগদা চিংড়ির মতোই কাঁকড়া উপকূলীয় লবণাক্ত পানিতে চাষ করা যায়।’বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘মোট রপ্তানির ৩০ ভাগেরও বেশি কাঁকড়া বাগেরহাটে উৎপাদন হয়। ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসে চীনে নানা উৎসব থাকে। এ সময় সেখানে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। করোনার সময় রপ্তানি বন্ধ থাকায় অনেকে লোকসানের মুখে পড়েছিল। তাদের প্রণোদনাসহ নানা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *