ePaper

রায়গঞ্জে মাটির নিচে ‘গুপ্তঘর’, খোলেনি রহস্যের জট

রফিকুল ইসলাম,সিরাজগঞ্জঃ

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে তৈরি করা রহস্যময় গুপ্তঘরটি নিয়ে রহস্যের জট দুদিনেও খোলেনি। কবর আকৃতির ওই ঘরে শিল্পী খাতুন (৩৮) নামে এক নারী এবং আব্দুল জুব্বার (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ বন্দি ছিলেন বলে দাবি করা হলেও তাদের শরীরে নির্যাতনের কোনো চিহ্ন মেলেনি। অপরদিকে একই ব্যক্তি দুটি গ্রামে দুটি গুপ্তঘর কেন তৈরি করেছেন- সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েই গেছে। এদিকে নারী ও বৃদ্ধকে আটকে রাখার অভিযোগে ওই গুপ্তঘরের মালিক গ্রাম্য চিকিৎসক নাজমুল ইসলাম আরাফাতসহ ২৫ জনকে আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে। দুটি মামলায়ই প্রধান আসামি আরাফাত। 

শনিবার (৩ মে) বিকেলে নাজমুল ইসলাম আরাফাতকে দুটি মামলাতে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। আরাফাত পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামের মৃত রেজাউল করিম তালুকদারের ছেলে। ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন চান্দাইকোনা ইউনিয়নের লক্ষ্মীবিষ্ণুপ্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী। আর আব্দুল জুব্বার একই ইউনিয়নের পূর্ব পাইকড়া গ্রামের বাসিন্দা। এর আগে শুক্রবার (২ মে) ভোরে রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সোনারাম গ্রামে দিনমজুর জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গোপন ঘর থেকে মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ পথ তৈরি করে বেড়িয়ে আসেন শিল্পী ও আব্দুল জুব্বার। 

রায়গঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এখনো প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে সোনারাম গ্রামে ভবনের মাটির নিচে কক্ষ পাওয়া গেছে। প্রতিটি কক্ষ মাত্র চার ফুট উঁচু, দৈর্ঘ্য নয় ফুট এবং প্রস্থ চার ফুট। তিনি বলেন, শিল্পী খাতুনকে চার মাস বন্দি রাখার অভিযোগে তার স্বামী মনছুর রহমান বাদী হয়ে একটি এবং আব্দুল জুব্বারকে পাঁচ মাস ২৫ দিন বন্দি রাখার অভিযোগে আব্দুল জুব্বারের ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আরাফাতকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। 

এদিকে শনিবার দুপুরে সোনারাম গ্রামে জহুরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গুপ্তঘর রয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা ওই ঘরটি ভেঙে ফেলেছেন। ঘরটির প্রতিটি কক্ষ একেকটি কবরের সমান। সামনে রয়েছে করিডোর, প্রতিটি কক্ষে প্রবেশের জন্য ছোট ছোট গেট রয়েছে। ঘরের পূর্ব কোণায় একটি মাটির সুরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়, যে সুরঙ্গ দিয়ে ওই নারী ও বৃদ্ধ পালিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। 

চান্দাইকোনা ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জহুরুল ইসলাম বলেন, সোনারাম গ্রামের জহুরুল একজন কুলি। তিনি খুবই দরিদ্র। তার ছেলে সুমন হোটেলে কাজ করে। কিছুদিন আগে একটি দুর্ঘটনায় জহুরুলের পা ভেঙে যায়। আমরা গ্রামবাসী চাঁদা তুলে তার চিকিৎসা করাই। হঠাৎ করে তার বাড়িতে ভবন নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সবার মনে সন্দেহ ছিল। আরাফাতের টাকায়ই এ ভবনটি নির্মাণ হচ্ছে বলে গ্রামবাসীর ধারণা। তিনি বলেন, মাটির নিচে যেভাবে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, সেটি একটি টর্চার সেল। সম্ভবত মানুষ ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হতো।  স্থানীয় বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, আরাফাতের বড় ভাই ঢাকায় ডাক্তারি করেন। তিনি নাকি কিডনি ও ভালভ তার ভাইকে সাপ্লাই দেন। 

সোনারাম গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামে নাজমুল ইসলাম আরাফাতের বাড়িতে গেলে তার ইরি ধানের প্রজেক্টে আরও একটি গুপ্তঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। ভয়ঙ্করভাবে নির্মিত এ গুপ্তঘরেও রয়েছে তিনটি কক্ষ। ভেতরের কোনো শব্দ বাইরে যাতে না আসে সেজন্য ঘরের বাইরে দুই স্তরের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বোঝা যায়, ওই কক্ষগুলো সদ্য নির্মিত। ওই প্রজেক্টে এমন গুপ্তঘর তৈরির বিষয়টি জানতেন পারেননি বলে গ্রামবাসী দাবি করেন।  স্থানীয়রা বলেন, আরাফাত কখনো সাংবাদিক, কখনো সমন্বয়কের পরিচয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান। তিনি গ্রাম্য ডাক্তার হলেও তার কোনো সার্টিফিকেট নেই। তার ভাই নাঈম আহমেদ বাঁধন সাভারে এনাম মেডিকেলের ডাক্তার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামের দাপট দেখিয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আরাফাতের বিরুদ্ধে মামলাবাজি, চুরি, ব্ল্যাকমেইলসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও গুপ্তঘরে মানুষ আটকে রাখার বিষয়টি সবারই অজানা ছিল। জুয়েল রানা নামে একজন বলেন, আরাফাত মানুষকে অপহরণ করে এনে এ গোপন ঘরে আটকে রাখতেন। এ চক্রটি কিডনি পাচারের সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারে। 

ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন বলেন, প্রায় ছয় মাস আগে তাকে তুলে নিয়ে যায় আরাফাত। এরপর হাত-পা বেঁধে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে প্রায় চার মাস আগে ওই গোপন ঘরটিতে রাখে। সেখানে আগে থেকেই ওই বৃদ্ধকে রাখা হয়েছিল। আরাফাত তাদের মেরে কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির কথাও বলেছিল। বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বারের পায়ে একটি ক্ষত ছিল, সেই ক্ষত ড্রেসিং করার জন্য ভেতরে একটি কেচি রেখে যায় আরাফাত। সেই কেচি দিয়ে চার/পাঁচদিন ধরে সুরঙ্গ তৈরি করে বের হন তারা। আব্দুল জুব্বার বলেন, তার কাছ থেকে আট বিঘা সম্পত্তি লিখে নেওয়ার চেষ্টা করেছে আরাফাত। সম্পত্তি লিখে না দেওয়ায় ব্যাপক নির্যাতন করেছে। গোপন ঘরে তাদের দিনে একবার খেতে দেওয়া হতো। গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। 

পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক। ওই বৃদ্ধ ও নারী সেখানে পাঁচ/ছয় মাস কীভাবে ছিলেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভবনটি দেখেও ছয় মাসের পুরোনো মনে হয় না। আবার গুপ্তঘরটি তৈরি হয়েছে সেটিও সঠিক। কোনো অপরাধমূলক কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য নিয়েই ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের। 

জানা যায়, ছয় মাস আগে শিল্পী খাতুন নিখোঁজ হওয়ায় তার স্বামী মো. মনছুর বাদী হয়ে গ্রাম্য ডাক্তার নাজমুল ইসলাম আরাফাত ও শরীফ মেম্বারসহ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। একই সময়ে বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় জিডি করেন তার ছেলে। দাবি করা হচ্ছে, গত শুক্রবার ভোরে সোনারাম গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের গুপ্তকক্ষে বন্দি থাকার পর কেচি দিয়ে মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ তৈরি করে মুক্ত হন শিল্পী খাতুন ও আব্দুল জুব্বার। 

সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. জিয়াউর রহমান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আমরা তেমন কিছু পাইনি। আসামি একজন ধরা পড়েছে, তাকে আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *