রিজু সরকার, বিশেষ প্রতিনিধি
অপচিকিৎসায় দুই রোগীর মৃত্যুসহ রিং বাণিজ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ ওঠা রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমানকে অন্যত্র বদলি বা পদায়ন করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সহকর্মীরা। এ নিয়ে হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ সকল চিকিৎসক একযোগে পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছেন। সোমবার হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রারসহ ১১ জন চিকিৎসক সহকর্মী ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ তাকে অন্যত্র পদায়ন বা বদলির আবেদন জানিয়ে ওই চিঠি দেন। হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হরিপদ সরকার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রবীন্দ্র নাথ বর্মন, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাহিদ, সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুল ইসলাম, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. আশেকুর রহমান, এবং সহকারী রেজিস্ট্রার ডা মো. আব্দুল আলীম সরকারসহ ১১ জন চিকিৎসক এতে স্বাক্ষর করেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। একই সঙ্গে ১১ চিকিৎসকের দেওয়া চিঠিটিও এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান কর্তৃক হার্টের রক্তনালীতে রিং পরানোর অনিয়ম নিয়ে ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লিখিত অভিযোগ করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রমেক হাসপাতাল কর্তৃক গঠিত পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি তদন্তও করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জেনেছি যে, ডা. মো. মাহবুবুর রহমান অভিযোগকারীদেরকে নানা রকম ভয়ভীতি ও অর্থনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছেন। চিঠিতেও চিকিৎসকগণ আরও বলেন, ডা. মো. মাহবুবুর রহমান রমেক হাসপাতালের ক্যাথল্যাবের নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনিয়ম করেছেন, ডাক্তার হিসেবে রিং বিক্রির নিয়ম না থাকলেও তিনি নিজেই রোগীদের কাছে উচ্চমূল্যে রিং বিক্রি করেছেন। বিষয়টিতে কার্ডিওলজি বিভাগে কর্মরত আমরা সকলেই অত্যন্ত বিব্রত এবং প্রতিনিয়ত রোগীদের এবং চিকিৎসক সমাজের নিকট থেকে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য ও অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছি। অনেকেই প্রায়ই আমাদেরকে প্রশ্ন করেন- তিনি কি আবারও এই বিভাগে ফিরে আসবেন এবং একই ধরনের কার্যক্রম করবেন। আমরা আমাদের অন্যান্য সহকর্মী চিকিৎসক এবং উদ্বিগ্ন রোগীদের এই ধরনের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারি না। এমতাবস্থায় ডা. মো. মাহবুবুর রহমান এ বিভাগে কর্মরত থাকলে তার অনিয়মের পুনরাবৃত্তি এবং রোগীদের প্রতিবাদের আশঙ্কাসহ বর্তমানে বিরাজমান সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে। বিধায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে ওই চিকিৎসগণ চিঠিতে উল্লেখ করেন। তারা চিঠির মাধ্যমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে রোগীদের সুচিকিৎসা ও কাজের পরিবেশ রক্ষার্থে অনতিবিলম্বে তাকে অন্যত্র পদায়ন/বদলি করার অনুরোধ জানান। এদিকে ‘চিকিৎসক হয়ে হার্টের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন, হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে অতঙ্কিত করে তোলেন’- এমন সব অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হতেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক মো. মাহবুবুর রহমান বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে অভিযোগ তুলে নিতে ‘চাপ ও হুমকি’ দিচ্ছেন বলে ২২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমান। জিডিতে আতোয়ার রহমান বলেন, ইতিমধ্যে ডা. মো. মাহবুবুর রহমান আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন লোকজনকে আমার বাড়িতে পাঠাচ্ছেন এবং ফোন দিয়ে অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন। মাহবুবুর রহমানের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমি ও আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায় ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বাণিজ্য ও রোগী মৃত্যুর বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের তদন্ত চলমান থাকায় কার্ডিওলজি বিভাগে ক্যাথল্যাবে তার ইউনিট বন্ধ করা হয়েছে। এখন তিনি কার্ডিলজি বিভাগে চিকিৎসা ও রিং পরানোর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বলে একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের নভেম্বরে গাইবন্ধার বাসিন্দা আতোয়ার রহমান নামে এক ভুক্তভোগী সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে তার রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) পরিয়ে তিনটি রিংয়ের টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ করেন। এছাড়াও ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বিক্রি ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর ছয়টি লিখিত অভিযোগ হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি অভিযোগ করা হয়েছে দুনীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রমেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জন অফিসে। একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহিন শাহ পরিচালক বরাবর দেওয়া অভিযোগে দাবি করেন, তার আপন খালু রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আফজাল হোসেন (৬৫) অপচিকিৎসায় ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর রিং পরানোর পর মারা যান। এ ঘটনায় ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। অন্যদিকে ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় লাল মিয়া (৫০) নামে রোগীর মারা যাওয়ার আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন তার স্ত্রী গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গুজাপাড়া গ্রামের মোসা. ফরিদা বেগম। লিখিত অভিযোগে ফরিদা বেগম বলেন, ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মাহবুবুর রহমান তার স্বামী লাল মিয়ার এনজিওগ্রাম করেন এবং অপারেশন করে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরান। প্রেসার কম থাকার পরও রিং পরানো হয়। এর চার দিন পর ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার স্বামী মারা যান।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আরেক ভুক্তভোগীর ছেলে মোহা. মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন, পেটে ব্যথা হলে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ডা. মাহবুবুর রহমান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করেন এবং বলেন যে তার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে ৭৫ শতাংশ ব্লক আছে তা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে রিং (স্টেন্ট) পরাতে হবে। কিন্তু তিনি যখন এনজিওগ্রামে সিডি অন্য দুজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখালে বলেন যে হার্টের রক্তনালীতে কোনো ব্লক নেই। তবে এসব অভিযোগ শুরু থেকে অস্বীকার করে আসছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান।