ePaper

রপ্তানি আরও এগিয়ে নেবে বিএসটিআইয়ের ‘হালাল ল্যাব’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য, প্রসাধন সামগ্রী প্রভৃতিকে ‘হালাল’ পণ্য বা সেবা বলা হয়। গত কয়েক বছর ধরে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো এ সনদ নিতে বেশ আগ্রহী। বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ গুরুত্বপূর্ণ। সনদের কারণে হালাল পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পণ্যের ক্ষেত্রে এ সনদ দেয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালে একটি হালাল ল্যাব উদ্বোধন করলেও যন্ত্রপাতির অভাবে সেটি এখনো সচল হয়নি। যে কারণে এর আগে সনদ দেওয়া দুটি সংস্থাই বাইরের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও প্রতিবেদন যাচাই করে হালাল সনদ দিতো। গত ১৪ জুলাই বিএসটিআইয় নিজস্ব ল্যাব উদ্বোধন করেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক মানের ওই ‘ন্যাশনাল হালাল ল্যাবরেটরি’ দেশের প্রথম ও একমাত্র সচল হালাল পরীক্ষাগার বলা যায়।

পণ্যের হালাল সনদ কেন দরকার?

পণ্যের হালাল সনদ বিশ্বব্যাপী মুসলিম ভোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিশ্চিত করে পণ্যটি ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী হালাল বা বৈধ। এতে কোনো হারাম বা নিষিদ্ধ উপাদান নেই। হালাল সনদ মূলত একটি পণ্যের ওই নিশ্চয়তা দেয় যে, পণ্যটি মুসলিমদের জন্য গ্রহণে কোনো বাধা নেই। পণ্যটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিশ্বে প্রতিনিয়ত হালাল পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। প্রতি বছর হালাল পণ্যের বাজার বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। বর্তমানে হালাল পণ্যের বাজার ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের, যা তৈরি পোশাকের দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্বে তৈরি পোশাকের বাজার ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের।যেহেতু অভ্যন্তরীণের পাশাপাশি হালাল পণ্যের প্রচুর রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু এতে আগ্রহী হচ্ছে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো। আগের চেয়ে এ কার্যক্রম আরও বেগবান হয়েছে। নিজস্ব ল্যাব প্রতিষ্ঠার পরে বিএসটিআইয়ের সক্ষমতাও বেড়েছে।- বিএসটিআইয়ের পরিচালক (রসায়ন) খোদেজা খাতুনবাংলাদেশ হালাল পণ্য রপ্তানি করছে। তবে এর পরিমাণ মাত্র ৮৪৩ দশমিক শূন্য ৩ মিলিয়ন ডলারের, যার বেশিরভাগই কৃষিভিত্তিক পণ্য। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজার ধরতে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে পণ্য রপ্তানির জন্য এ সনদ দরকার হয়। বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক ও হালাল ল্যাবের ইনচার্জ শরীফ মো. সৈয়দুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো পণ্যের হালাল সনদের জন্য প্রথমে বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত ফরমে সংস্থাটির মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হয়। আবেদন করার সময় প্রতিষ্ঠান ও কারখানার নাম-ঠিকানা, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, রেজিস্ট্রেশন, স্বাস্থ্য পরিবেশ ও অগ্নিনির্বাপক সনদ, ব্র্যান্ড ও পণ্যের ট্রেডমার্কসহ আরও কিছু কাগজপত্র লাগে।

এরপর বিএসটিআইয়ের হালাল নিরীক্ষা দল, যেখানে টেকনিক্যাল ও শরিয়াহ মোতাবেক সদস্যরা থাকেন, তারা ওই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। যারা কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে পণ্য উৎপাদনের প্রতিটি ধাপের কার্যক্রম যাচাই-বাছাই করে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা সংশোধনের জন্য সময় বেঁধে দেন।

রপ্তানি আরও এগিয়ে নেবে বিএসটিআইয়ের ‘হালাল ল্যাব’

এরপর সেসব সমাধানের পরে দ্বিতীয় ধাপে ওই কারখানা থেকে সংগ্রহ করা কাঁচামাল ও অন্য পণ্য পরীক্ষার জন্য হালাল ল্যাবরেটরিতে নেওয়া হয়। সে সময় শূকরের কোনো উপাদানের উপস্থিতি, অ্যালকোহল, কীটনাশক, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।

সবকিছু যাচাইয়ের পরে সন্তোষজনক হলে হালাল কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়। বিএসটিআইয়ের ওই ১৫ সদস্যের কমিটি সন্তুষ্ট হলে সনদ দেন। কোনো শর্তের ব্যত্যয় হলে বিএসটিআই পরে হালাল সনদ স্থগিত বা বাতিল করতে পারে।

খরচ কত?

শুরুতে আবেদনের জন্য খরচ হয় এক হাজার টাকা। এরপর পরীক্ষার জন্য একজন আবেদনকারীকে ফি দিতে হয় সবোর্চ্চ ২৩ হাজার ৮০০ টাকা। আর সনদ পেলে ক্ষুদ্র শিল্পে সনদ বা নবায়ন ফি এক হাজার টাকা, যা মাঝারি শিল্পে তিন হাজার ও বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা প্রতি বছর।

বিশ্ববাজারের ৪০টি দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে একটি বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। যেখানে রপ্তানির জন্য বাধ্যতামূলক হালাল সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। এখন বিএসটিআই থেকে আমরা বিভিন্ন পণ্যের হালাল সার্টিফিকেট নিতে পারছি। আগে এ সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য বিদেশ যেতে হতো।- লিম্পিকের ডেপুটি ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স) মোস্তফা কামাল

সনদ পেলে পণ্যের গায়ে বা লেবেলে অথবা প্রক্রিয়া বা সেবার অনুকূলে হালাল মার্ক ব্যবহার করা যায়।

হালাল সনদে আগ্রহ বাড়ছে

২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হালাল সনদ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছিল বিএসটিআই। এ পর্যন্ত ১৮৩টি পণ্যের হালাল সনদ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন দিন দিন এ সনদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বিএসটিআইয়ের পরিচালক (রসায়ন) খোদেজা খাতুন বলেন, ‘যেহেতু অভ্যন্তরীণের পাশাপাশি হালাল পণ্যের প্রচুর রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু এতে আগ্রহী হচ্ছে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো। আগের চেয়ে এ কার্যক্রম আরও বেগবান হয়েছে। নিজস্ব ল্যাব প্রতিষ্ঠার পরে বিএসটিআইয়ের সক্ষমতাও বেড়েছে।’এদিকে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রাণ, নেসলে, অলিম্পিক, আকিজ, কোকোলা ফুড, রিমার্ক এইচবি, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, আকিজ বেকার্স লিমিটেড, বেঙ্গল মিট, নিউজিল্যান্ড ডেইরির মতো অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান হালাল সনদ নিয়েছে।

অলিম্পিকের ডেপুটি ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স) মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিশ্ববাজারের ৪০টি দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে একটি বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। যেখানে রপ্তানির জন্য বাধ্যতামূলক হালাল সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। এখন বিএসটিআই থেকে আমরা বিভিন্ন পণ্যের হালাল সার্টিফিকেট নিতে পারছি। আগে এ সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য বিদেশ যেতে হতো। বাড়তি খরচ ও ঝামেলা ছিল। এ সনদ চালু করায় আমরা সুফল পাচ্ছি।’

দেশের প্রসাধনী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের অপারেটিভ ডিরেক্টর আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে আমরা প্রথম কোনো প্রসাধনী, স্কিন ও হোমকেয়ার পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবে প্রতিটি পণ্যের জন্য হালাল সনদ নিচ্ছি। আমরা এরই মধ্যে ২৪টি পণ্যের হালাল সনদ পেয়েছি। এছাড়া দুইশ’র বেশি পণ্যের সনদের আবেদন প্রক্রিয়াধীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *