নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআর) সফল বাস্তবায়নের ফলে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে পরিবেশের উন্নতির পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদী (২০১৯-২০২৫) ইআইআর প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত নদী, খাল, বিল, পুকুর এবং জলাশয় পুনঃখনন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাপক বৃক্ষরোপণ রংপুর অঞ্চলে প্রকল্প এলাকায় আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তৈরি করেছে।এছাড়াও, পুনঃখনন করা এই জলাধারগুলোতে কার্যকরভাবে সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পুনরায় রিচার্জ করতে এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানির সংরক্ষণ এবং কৃষি ও গৃহস্থালী কার্যক্রমে এর সর্বোত্তম ব্যবহারে অবদান রাখছে।কৃষি, মৎস্য চাষ, বৃক্ষরোপণ, শাকসবজি, কলা ও ঘাস চাষ, গবাদি পশুর খাবার এবং জীবিকা উন্নত করার জন্য হাঁস পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষ এই প্রকল্প থেকে বহুমাত্রিক সুবিধা পাচ্ছেন।
পুনঃখনন করা বিল ও পুকুরের পুরো জলাভূমি এবং তীরে হারিয়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির ২১৩ প্রকারের গাছের সমাহার এখন বিভিন্ন অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভরে উঠেছে। ফলে, চারপাশে সবুজের মাঝে দর্শনীয় দৃশ্য তৈরি হয়েছে।কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধা জেলার ৩৫টি উপজেলায় ২৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
বাসস’র সাথে আলাপকালে ইআইআর প্রকল্প পরিচালক এবং বিএমডিএর রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, প্রকল্পটি থেকে অনেক মানুষ প্রচুর সুবিধা ভোগ করছেন।প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সংরক্ষিত ভূ-পৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার, বনায়ন, উন্নত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এবং জলাশয় ও সবুজায়িত পাহাড়গুলো স্থানীয়ও অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত নদী, খাল, বিল এবং পুকুর পুনঃখনন, লো-লিফট পাম্প স্থাপন, সৌরবিদ্যুৎ চালিত খননকৃত কূপ এবং ফুটওভার ব্রিজ, ক্রস ড্যাম নির্মাণ এবং বৃক্ষরোপণ বাস্তবায়িত হয়েছে।ই জলাশয়গুলোর পুনঃখননের ফলে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টি ও বন্যার পানির নিষ্কাশন সহজ হয়েছে এবং জলাবদ্ধ জমি জলাবদ্ধতামুক্ত হয়ে কৃষিকাজের উপযোগী হয়ে উঠেছে এবং কৃষি, গৃহস্থালি এবং অন্যান্য কাজে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।প্রকল্প এলাকার কৃষকরা পুনঃখননকৃত জলাশয়ে সংরক্ষিত ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে ফসলি জমিতে পরিপূরক সেচ প্রদান, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস এবং অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্য কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন করছেন। আগামী জুন মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে চলেছে।বাসস’র সাথে আলাপকালে প্রকল্প এলাকার গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, তারা চার দশক পর পুনঃখননকৃত বিলুপ্ত জলাশয়ের চারপাশে হারিয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্রের পুনরুজ্জীবিত হতে দেখছেন যেখানে আবারও তাজা পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রয়েছে।জলাশয় পুনঃখননের ফলে মানুষের জন্য সেচ, গৃহস্থালীর কাজ, বনায়ন ও হাঁস পালন, মাছ, কলা, শাকসবজি এবং তীরে নেপিয়ার ঘাসের চাষের জন্য ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার সংকরপুর গ্রামের কৃষক মশিউর রহমান বলেন, বিলুপ্ত প্রায় মড়া তিস্তা নদীর পুনঃখননের ফলে নদীতে জল প্রবাহ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বৃষ্টি ও বন্যার পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে এবং বিস্তীর্ণ এলাকার জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে আবারো আবাদী জমি হয়েছে।তিনি বলেন, ‘পুনঃখনন করা নদী দ্রুত বৃষ্টির পানি যমুনেশ্বরী নদীতে প্রবাহিত করেছে। যার ফলে আমার ২.৬২ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে এবং আমি চার দশক পর ওই জমিতে আবারো আমন ধান চাষ করতে সক্ষম হয়েছি।’ পার্শ্ববর্তী কালুপাড়া ইউনিয়নের ঝারপাড়া গ্রামের গৃহিণী হোসনে বেগম বলেন, নদীর পুনঃখননের পর তিনি মড়া তিস্তা নদীতে হাঁস পালন এবং পাড়ে কলা ও শাকসবজি চাষ করে তার জীবিকা উন্নত করছেন।একই উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামের কৃষক গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘বিলুপ্ত প্রায় ঘিরনই নদীর পুনঃখননের ফলে আমার দেড় হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, চার দশক পর এখন তিনি তার ওই জমিতে বছরে তিনটি ফসল চাষ করছেন।পার্শ্ববর্তী কুঠিপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ তুহিন মিয়া বলেন, তিনি ঘিরনই নদীর পুনঃখননের ফলে সেখানে সৃষ্ট পানির ধারায় মাছ ধরছেন যেখানে তীরে গাছের চারা রোপণের ফলে প্রকৃতি সবুজ হয়ে উঠেছে।এদিকে, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় ১০০ ফুট প্রশস্ত তীরের ভরদারদহ বিল পুনঃখননের পাশাপাশি সেখানকার পাড়ে ২১৩ প্রজাতির বিরল কাঠ, ফল, ঔষধি এবং ফুলের গাছ লাগানোর ফলে এক মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি হয়েছে।পার্শ্ববর্তী গ্রামের গোলজার রহমান বলেন, ‘চারদিকে সবুজের মাঝে বিলে পানিতে এবং বাতাসে হাজার হাজার অতিথি পাখির কিচিরমিচির এবং তাদের ডানার অবাধ বিচরণ সেখানে প্রতিদিন আগত মানুষদের আকর্ষণ করে তাদের চিত্তকে প্রফুল্ল করে তুলছে।’ প্রচুর উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের সমারোহে বিলটি পুনরুজ্জীবিত বাস্তুতন্ত্রে স্থানীয় মাছ ও পাখির জন্য একটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং ফুটন্ত ফুল উপভোগ করার জন্য সেখানে ছুটে আসছেন।কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বেরু বাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মোতালেব বলেন, বিএমডিএ বোয়ালেরদারা খালের বিরাট অংশ পুনঃখনন করার ফলে এলাকার ৩০টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ উপকৃত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘খালটি পুনঃখননের পাশাপাশি পাড়ে গাছের চারা রোপণের ফলে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। স্থানীয় জনগণ ফসলের ক্ষেতে সম্পূরক সেচ, হাঁস পালন, মাছ চাষ এবং গৃহস্থালীর কাজে সেখানে সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছেন।’