আশরাফ ইকবাল, মুন্সিগঞ্জ
মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বিমান বন্দর ও পদ্মা সেতু নির্মানের ঘোষণার পর থেকেই শ্রীনগর ও লৌহজংয়ের জায়গা জমির দাম বেড়ে যায় বিদ্যূৎ গতিতে। এ সুযোগে স্থানীয় ভূমি খেকোরা সরকারী খাস ও অর্পিত সম্পত্তি দখলের পাশাপাশি খাল দখলের বেপরোয়া ভাবে প্রতিযোগীতায় মেতে উঠেছে। লৌহজং ও শ্রীনগর উপজেলার অধিকাংশ খাল এখন ভূমি দস্যুদের দখলে। তারা সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দখলের মহোৎসবে নেমে পড়েছে। দখলদারদের কবলে পড়ে নাব্যতা হারিয়ে মরে যাচ্ছে, লৌহজংয়ের হলদিয়া, কনকসার, গোয়ালীমান্দ্রা শ্রীনগর খাল, বাড়ৈখালি ও শেখরনগর খাল। ভয়াবহ দখলের কারণে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে দেউলভোগ হরপাড়া খাল ও গড়িয়া ভাঙ্গা ধোপাবাড়ীর খাল। লৌহজং উপজেলার কনকসার-নাগেরহাট খাল, হলদিয়া-গোয়ালী মান্দ্রা, মাশুরগাঁও খালের দুই পার অবৈধভাবে দখলের কারণে খাল গুলো চেপে গিয়ে শরু হয়ে গেছে। একসময় এখাল দিয়ে লঞ্চ যোগে এখানকার মানুষ দুরদরান্তে যাতায়াত করতো। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পদ্মা নদী থেকে হলদিয়া খাল হয়ে লঞ্চ যোগে পাক হানাদার বাহিনী শ্রীনগর যাওয়ার পথে গোয়ালীমান্দ্রায় এলে মুক্তি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হন। শ্রীনগর উপজেলা সদরের দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এসব খালের দুপাশের সরকারী জায়গা দখল করে প্রভাবশালীরা পাকা বাড়ীঘর ও দোকানপাট নির্মাণ করছে। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ঘটলেও তারা না দেখার ভান করে বরং আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এতে একদিকে পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের বেহাত হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। কেউ কেউ এসকল খালের পাড়কে নিজস্ব সম্পত্তি বলে দাবি করছেন বলে জানা গেছে। বৃটিশ আমলে পশ্চিম বিক্রমপুরের শ্রীনগর বাজার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বর্তমান গোয়ালীমান্দ্রা শ্রীনগর খালটি ছিল পদ্মা ধলেশ্বরীর সংযোগ রক্ষকারী একটি খাল। নদী সদৃশ্য ছিল বলে খালটিকে পদ্মার শাখা নদীও বলা হতো। এ নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ, বেপারীদের হাজার মনি নৌকা আর মালবাহী ট্রলার চলাচল করতো। এছাড়া বোরো মৌসুমে গোয়ালীমান্দ্রা থেকে আড়িয়াল বিলের আলমপুর পর্যন্ত খালের দুপাশের প্রায় ৭৫ হাজার একর ধানি জমিতে পাওয়ার পাম্পের মাধ্যমে সেচ দেয়া হতো এ খাল থেকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে অবৈধ দখলদারদের কড়াল থাবা আর সংস্কারের অভাবে ক্রমেই ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে এ খালটি। এক সময়ের বহতা এ খাল যৌবন হারিয়ে আজ যেন মরমর অবস্থা। বিগত ৫৩ বছরে খালটি খনন না করায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে পদ্মা থেকে নেমে আসা পলিতে খালের দুপার ভরাট হয়ে চর পরে গেছে। এ সুযোগে দখলবাজরা স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে হাত করে নানা ছলে গিলে খাচ্ছে খালের দুই পাড়ের জমি। সরজমিনে দেখা গেছে, শ্রীনগর লঞ্চঘাট থেকে দক্ষিণ পাইকশা পর্যন্ত খালের দুই পাড়ের জায়গা স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। ভূমি অফিসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগ সাজশে এসব খালের পাড় প্রভাবশালীরা দখল করে নিচ্ছে। একইভাবে দখল করে নিয়েছে শ্রীনগর বাজারের উত্তর দিকের ধোপাবাড়ী গড়িয়া ভাঙ্গা খাল এবং ভূমি অফিস সংলগ্ন পূর্ব দিকের দেউলভোগ হরপাড়া খালটি। বিশেষ করে হরপাড়া খালটি এমনভাবে ভরাট করা হয়েছে যার কোন চিহ্নই রাখা হয়নি। কেবল কালের স্বাক্ষী হয়ে হবি ডাক্তারের বাড়ীর পশ্চিম দিকের ব্রীজের রেলিং দুটি জেগে না থাকলে বুঝাই যেতনা এখানে একটি খাল ছিল। এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, খালটির নাম নিশানা গায়েব করে দেয়ার জন্য দখলবাজরা কালের স্বাক্ষী ঐ ব্রীজের রেলিং দুটি ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। কেউ কেউ আবার মামলার ভয়ে বাধা দিচ্ছে বলেও জানা গেছে। শ্রীনগরে খাল দখলের কৌশল হিসেবে দুই পাড়ের দোকানদার ও বাড়ী ওয়ালারা প্রথমে ময়লা আবর্জনা ফেলে কাঁচা পাকা খুটি দিয়ে ৩০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা টংঘড় তৈরী করে। শুকনা মওসুমে খালের মাঝ খান থেকে অপরিকল্পিতভাবে মাটি কেটে টংঘরের নীচে কিংবা খালের পাড় ভরাট করতে থাকে। এরপর সুযোগ বুঝে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফাউন্ডেশন দিয়ে তৈরী করে ফেলে পাকা স্থাপনা। তবে শ্রীনগর হরপাড়া খালটি বর্ষা মৌসুমে ভরাট হয়েছে ড্রেজারের বালি দিয়ে। এ ধরনের খাল ভরাট যারা করেছেন তাদের ব্যাপারে তৎকালীন শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানালে কার্যত কোন প্রশাসনিক পদক্ষেপ না থাকায় এখনো খাল দখলে স্বক্রিয় রয়েছেন। ফৈনপুর ব্যাটারী কারখানার দক্ষিণে, কামারখোলা পাকা ব্রীজের দক্ষিণ পূর্ব পাড়ে, মাশুরগাঁও বাদল ব্যাপারীর বাড়ীর দক্ষিণে, পুরাতন ফেরী ঘাটের উত্তরে, অনেকেই খাল ভরাট করে বাড়ীঘর তৈরীসহ দখল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসনকে কেউ জানালেও কখনো মোবাইল কোর্ট কিংবা উচ্ছেদের ভূমিকায় যেতে দেখা যায়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে অন্যান্য খালের মত শ্রীনগর গোয়ালীমান্দ্রা হলদিয়া খালটিও দু এক বছরের মধ্যে নালায় পরিনত হবে। ফলে বন্ধ হয়ে যাবে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ। সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা। পরিবেশ হবে বিপর্যস্ত। অকাল বন্যায় আড়িয়াল বিলে ফসল ডুবির যে ঘটনা শুরু হয়েছে তা রূপ নিবে ধারাবাহিকতা। তাই অনতিবিলম্বে দখলদারদের কবল থেকে শ্রীনগর গোয়ালীমান্দ্রা হলদিয়া খাল পুনরুদ্ধার করে ড্রেজিং এর মাধ্যমে বহতা করে তোলা লৌহজং ও শ্রীনগরবাসীর দাবী। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নেছার উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি সংবাদ পেয়ে কনকসার- নাগেরহাট খালের বেশ কিছু অবৈধ দখলীয় স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে আমাদের কাছে নর্দিষ্ট করে অভিযোগ দিলে আমরা যাচাই-বাছাই করে দ্রুত তা অবৈধ দখল মুক্ত করবো। আমাদের এধরণের অভিযান চলমান রয়েছে।
