ভোরের আলো ফোটার আগেই সিরাজগঞ্জে জমে উঠে মানুষ বিক্রির হাট

রফিকুল ইলাম, সিরাজগঞ্জ

সাধারণ নিয়মে টাকার বিনিময়ে পণ্য বিক্রি হলেও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল, কান্দাপাড়া, কাজিপুরের নাটুয়ারপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হাটের বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ নিজেই পণ্য। নির্ধারিত একটি সময়ের জন্য একজন আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে যান। সিরাজগঞ্জের কান্দাপাড়া, শিয়ালকোল, কাজিপুরের আলমপুর, রতনকান্দি, নাটুয়ারপাড়া, কুমারিয়াবাড়ি, পানাগাড়ি, ও সোনামুখী এলাকায় এই মানুষ বিক্রির হাট এখন জমজমাট। প্রতিদিন সকালে হাট শুর” হয়। ৭টার মধ্যে এই শ্রমজীবি মানুষদের ক্রয় করে নিয়ে যায়। বতর্মানে ধান কাটার মৌসুমে মাঠে পাকা ধান কাটা শুর হয়েছে। কর্মজীবি দিনমুজরদের প্রয়োজন কাজ। এ কারণে কৃষকদের কাছে শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে অনেক। তাছাড়াও অন্যান্য কাজেও শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। তাই শ্রমিকের দামও থাকে বেশ চড়া। প্রতিটি শ্রমিকের মূল্য ৭ শত থেকে সাড়ে ৭ শত টাকার নিচে কোন শ্রমিক পাওয়া যায় না। এ সকল হাটে ১৫ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সে কৃষি শ্রমিক দেখা যায় বেশি। সরেজমিনে বিভিন্ন হাটে গিয়ে দেখা যায়, কারো হাতে বাঁশের তৈরি বাইং, কারো হাতে ব্যাগ। ব্যাগে হালকা কাপড়-চোপর আর কাঁচি। কেউ বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে। হাটের ভেতরে ঢুকতেই কতিপয় শ্রমিক বলেন ‘মামা কামলা নাগবো? কত কইরা দিবেন? সদর উপজেলার শিয়ালকোল গ্রামের শ্রমিক আমজাদ (৪৩) সহ ৭ জনের একটি দল হাটে আসেন। এ সময় তাকে জিজ্ঞাস করলে সে জানায়, সংসারে বিধবা মা, ৩টি বোন সহ স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে রয়েছে। তাদের ভরণপোষনের জন্য তাকে কর্মের পথ বেচে নিতে হয়েছে। ১৭ বছরের কিশোর আলামিন জানায়, আমার বাড়ীতে বিধবা মা রয়েছে। তাকে ভরণপোষন ও চিকিৎসার জন্য এই কর্মের পথ বেচে নিতে হয়েছে। ছোট বলে কেউ আমাকে কিনতে চায় না। তাই অল্প দামে বিক্রি হতে হয় আমাকে। অন্য ৬ জন ৭৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছেন। তিনি আরো বেশি দামে বিক্রি হওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছে এক প্রশ্নের জবাবে বলে, ‘আমাদের এলাকায় এখন কোনো কাজ নাই। বইসা থাইকা কি করমু? তাই এহনে বোরো ধান ও মাটি কাটার জন্য আইছি। কিছু টাকা জমিয়ে চইলা যামু। নাটুয়াপাড়ার চরাঞ্চলের হাতেম আলী (৪৫) জানায়, ‘তার ৮ বিঘা জমি ছিল। ১৬ বছর আগে রাক্ষষী যমুনা নদী তা কাইড়া নিছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে এখন অন্যের জায়গায় থাকি। এজন্য নিজেকে ভাড়া দিতে হয়। ৬০ বয়সের বৃদ্ধ আজাহার আলী জানায়, ছেলেরা যার যার মতো সংসার পেতে নিয়েছে। ওদের বাবা-মার ভরণ পোষনের সময় তাদের নেই। তাই বৃদ্ধ বয়সে বাড়ী থেকে বের হয়ে বিক্রির জন্য কান্দাপাড়া হাটে এসেছি। জানা যায়, বগুড়ার ধুনুটের বাঁশপাতা গ্রাম থেকে আসা আজাদ সহ একাধিক শ্রমিক বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আরো অনেকেই বিক্রি হওয়ার আশায় রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নাটুয়ারপাড়া হাটে দাঁড়িয়ে ও বসে থাকে। বিক্রি না হতে পারলে নাটুয়ারপাড়া স্কুল, মাদরাসা ও কলেজ মাঠে রাতে থাকে। তাছাড়াও জামালপুর থেকেও শ্রমিক আসেন এখানে। বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, এখন একজন শ্রমিকের দাম ৭ শত থেকে সাড়ে ৭ শত টাকা। তাতে তিনবেলা খাবারসহ এক কামলার দাম পড়ে কমপক্ষে ৮৫০ টাকা। আর এখন বাজারে এক মণ ধানের দামও ১১শত থেকে ১২শ টাকা মন। নাটুয়ারপাড়া গ্রামের জনৈক ইদ্রিস আলী নামক গৃহস্ত’ জানান, কামলার দাম গত বছরের চেয়ে এবার বেশি। তবু কিছু করার নেই। তাই বেশি দাম দিয়েই কামলা কিনতে হয়েছে। কাজিপুর উপজেলার মাজনাবাড়ি গ্রামের কৃষক হালিম বলেন, ‘আমি নাটুয়ারপাড়া থেকে সাড়ে ৭ শত টাকা দরে পাঁচ জন কামলা (শ্রমিক) কিনছি। উত্তরবঙ্গের কামলাদের কাজের মান ভালো। কাজে কোনো ফাঁকি দেয় না। তাদের তিনবেলা খাবার দিতে হয়। আর কাজ করে ভোর থেকে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত। সিরাজগঞ্জের তাড়াশের কুন্দাইল গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, জেলার কৃষি শ্রমিকেরা হাওর এলাকায় ধান কাটার জন্য যাবার কারণে কৃষি শ্রমিকের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *