ePaper

ভারতের পাহাড়ি ঢলে ফেনীতে নদীর ২১ স্থানে ভাঙ্গন ৯৮ গ্রাম প্লাবিত

সাহেদ চৌধুরী, ফেনী

গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢলে ফেনী জেলার পরশুরাম, ফুলগাজীর বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী, দাগনভূঁঞা ও ফেনী সদরের নিম্নাঞ্চলও পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এদিকে মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ায় সোনাগাজী ও দাগনভূঁঞা উপজেলার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। ছোট ফেনী নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। ভারতের ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যার কবলে পড়ে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। ২০২৪ সালের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে। ওই বন্যায় পুরো ফেনী জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মারা যান ২৯ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে তখন লক্ষ লক্ষ কিউসেক পানির নিচে তলিয়ে যায় ফেনীর জনপদ। এবারও টানা বর্ষণে ত্রিপুরায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকে ত্রিপুরা একটি পাহাড়ি এলাকা। ফলে সেখানে বৃষ্টি হলেই পানি গড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে। ত্রিপুরার কোল ঘেঁষে বয়ে চলা ফেনী নদী এবং পরশুরামের মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া ও অভয়া নদী হয়ে সেই পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পুরো ত্রিপুরা রাজ্যের পানির চাপে বাংলাদেশের এসব নদ-নদীর দুই কূল ছাপিয়ে লোকালয়ের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়। অতিরিক্ত পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বেড়িবাঁধের ২১ স্থানে ভাঙন এবং ৯০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চলতি বছর ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর মুহুরী, কহুয়া এবং সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ২১টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এতে গত কয়েকদিনে অন্তত ৯০টি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বন্যায় ফুলগাজী ও পরশুরামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে ফুলগাজী উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ঘরবাড়িতে ৫-৬ ফুট পর্যন্ত পানি ঢুকেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে ফেনী-বিলোনিয়া আঞ্চলিক সড়কের অধিকাংশ অংশ। এছাড়া নতুন করে পানিতে ডুবেছে ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক সড়কও। এদিকে ফেনীর উত্তরাঞ্চলের পানি নিচু এলাকায় নামতে শুরু করেছে। এতে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর নতুন করে জলমগ্ন হচ্ছে। সড়কে পানি ওঠায় ফেনী-ছাগলনাইয়া পথে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। মানুষ ট্রাক, ট্রাক্টর ও ট্রলিতে যাতায়াত করছে। ইতোমধ্যে উজানের পানিতে ছাগলনাইয়ার বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি ক্রমেই ভাটির দিকে নামছে। বিকাল নাগাদ ফেনী সদরের আরও কিছু গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে ৪০টি গ্রামের প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে ফেনী শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এসময় বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নিম্নাঞ্চলের মানুষ সরে আসে। মঙ্গলবার বিকাল থেকে ফুলগাজী ও পরশুরামে বেড়িবাঁধে ভাঙন শুরু হয়। এতে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতে থাকে। মঙ্গলবার ও বুধবার সকাল নাগাদ হাজারো মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত বন্যাদুর্গত এলাকার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় আট হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তবে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি। কেউ কেউ বাড়ির ছাদ বা উঁচু স্থানে অবস্থান করছেন। গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি রেখে বাড়ি ছাড়তে অনিচ্ছুক অধিকাংশ মানুষ, ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে অনেকে না খেয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। পরশুরামের সাতকুচিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৭০০ জন আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া চিথলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও ফুলগাজীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষÑজানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম। বন্যার্তদের পাশে রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো দাঁড়িয়েছে। ফেনী জেলা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা বন্যাদুর্গত এলাকায় উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ বিতরণে অংশ নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে ফুলগাজীর দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও ফেনী-১ আসনের সাংগঠনিক সমন্বয়ক রফিকুল আলম মজনু। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই ভারতের পানি ফেনী অঞ্চলকে প্লাবিত করে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছি। গত ১৫ বছর বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকার ভারতের তাঁবেদারি করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরাও দুর্গত এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ফেনী জেলা জামায়াতের আমির আবদুল হান্নান জানান, তিনি নিজেই ত্রাণ বিতরণে অংশ নিচ্ছেন এবং মাঠে জামায়াতের প্রায় ৩ হাজার নেতাকর্মী কাজ করছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র জানান, পরিস্থিতি অনুযায়ী উদ্ধার অভিযান আরও জোরদার করা হবে। ফুলগাজী ও পরশুরামের বন্যা পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়বে কি না, তা নজরে রাখা হচ্ছে। পানি বাড়লে গতবারের মতো বড় পরিসরে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া মাঠে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। জেলা-উপজেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও অক্লান্ত পরিশ্রমে দুর্গতদের উদ্ধার, খাবার, ত্রাণ, বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইন, মোমবাতি ইত্যাদি পৌঁছে দিচ্ছেন। উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ তৎপরতায় সেনাবাহিনী ও বিজিবিও যুক্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তারা মাঠে নামে। বিজিবি-৪ ব্যাটালিয়নের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মোশারফ হোসেন জানান, জনজীবন পুরোপুরি অচল না হলেও আমরা দুর্গত এলাকায় ব্যাপকভাবে কাজ করছি। সেনাবাহিনীর টিমগুলো ফুলগাজীর দুর্গম এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করছে সেনাবাহিনী। এদিকে পানি কমতে শুরু করেছে। পরশুরাম ও ফুলগাজীর নদীগুলোর পানি বিপদসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভাটির দিকে পানি দ্রুত নামছে। মুহুরী প্রজেক্টের ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে পানি দ্রুত বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে। ফেনী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আখতার হোসেন মজুমদার জানান, জোয়ারের সময় ছাড়া সবসময় গেটগুলো খোলা রাখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ২.৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ করে ফুলগাজীর নিম্নাঞ্চলে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সেনাবাহিনী স্পিডবোট ও নৌকা নিয়ে কাজ করছে। তিনি আরও জানান, পানি শুকাতে শুরু করেছে, বৃষ্টি কমে এলে আজকের মধ্যেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০.০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই হারে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যার পানি দ্রুত নামবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *