জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে টানা তিন দিনের সংলাপ শেষে নির্বাচন, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রস্তাবের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তবে ৬৯৪টি প্রস্তাবের মধ্যে অধিকাংশে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে দলটি।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে বিএনপির সঙ্গে তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ, নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস এবং সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান। ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হকসহ অন্যান্য সদস্যরা।
বিএনপির আপত্তির মুখে যেসব প্রস্তাব
আলোচনায় বিএনপি নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান ও প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু মূল প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেছে। আলোচনার শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ জানান:
- নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহিতা নিয়ে সংসদীয় কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয়। তাদের মতে, এতে ইসির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে।
- আসন সীমানা নির্ধারণে আলাদা কমিশন গঠনের প্রস্তাবেও দলটি দ্বিমত পোষণ করেছে।
- এক ব্যক্তি একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিলের প্রস্তাবেও আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত হলেই নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার প্রস্তাবেও তারা একমত নয়, যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করে ‘অভিযোগ মানেই দোষী নয়’।
সংবিধান সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ মতভেদ
সংবিধান সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রস্তাব ছিল রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ—আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য আনতে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন। বিএনপি মনে করে, এটি সরকারকে দুর্বল করবে। দলটি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষপাতী হলেও, কীভাবে তা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেয়নি।
তারা এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তারা মধ্যবর্তী বিরতিসহ সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে মতামত দেননি।
আরও যেসব বিষয়ে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে
- সংসদের মেয়াদ চার বছর করা
- সংবিধানে গণভোট বাধ্যতামূলক করা
- রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন
- সংবিধানের নামে পরিবর্তন
- সংসদ নির্বাচনে ন্যূনতম বয়স ২১ বছর নির্ধারণ
- আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সংসদের দ্বৈত অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা
যেসব প্রস্তাবে একমত বিএনপি
বিএনপি সংবিধান সংস্কারের অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ৭(ক) ও ৭(খ) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা
- সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা
- বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ
- রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া চালু
- স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখা
- ন্যায়পাল এবং স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন
- সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার
- প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিকল্প পদ্ধতির প্রস্তাব
ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবেও একমত হয়েছে বিএনপি।
আলোচনা চলমান থাকবে
আলোচনার শুরুতে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আছি। রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকেরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে অংশ নেবেন।’ বিএনপিও জানিয়েছে, মতভিন্নতা থাকা প্রস্তাবগুলো নিয়ে দলের ভেতরে আরও আলোচনা করে পরবর্তী অবস্থান জানাবে।