ePaper

বিএনপিকে চাপে রাখতে জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও সাংবিধানিক সংস্কারের দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীর), খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। রাজনৈতিক মহল বলছে, এই আন্দোলন ভবিষ্যতে জোটে রূপ নিতে পারে। আপাতত তাদের লক্ষ্য নির্বাচনের আগে সরকার ও বিএনপিকে চাপের মুখে ফেলা। গত সোমবার জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন আলাদা সংবাদ সম্মেলনে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে কর্মসূচি ঘোষণা করে। খেলাফত মজলিস ছয় দফা এবং মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আগের দিন পাঁচ দফা দাবি জানায়। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দলগুলো সনদ বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, গণহত্যার বিচার, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে আগামী বৃহস্পতিবার ঢাকায়, শুক্রবার বিভাগীয় শহরে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করবে। যদিও কর্মসূচি এক, তবে মঞ্চ হবে আলাদা। রাজনৈতিক সূত্র বলছে, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল এই আন্দোলনে যোগ দিতে পারে। শনিবারের বৈঠকে উপস্থিত এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, নির্বাচনে সমান সুযোগ এবং আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতে একমত হয়েছে। তবে তারা জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো সংসদে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় না। তাদের দাবি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর। যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেওয়া দুই খেলাফত মজলিসও শুধু উচ্চকক্ষে পিআর চায়। এনসিপি ও এবি পার্টি সূত্র জানিয়েছে, ডানপন্থি ‘ট্যাগ’ এড়াতে তারা এখনই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বা যুগপৎ আন্দোলনে যেতে চায় না। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর সমঝোতা হতে পারে। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণঅধিকার পরিষদ সেখানেই থাকতে চায়। আবার দলটি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন চায়। নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার সূত্র জানিয়েছে, তাদের দাবি জামায়াতের কাছাকাছি হলেও এখনই জোট করবে না। জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে ৮৪টি সংস্কারের সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। ১১টিতে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা রহিত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, কমিটির মাধ্যমে দুদকের নিয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়াসহ ৯ সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। জানিয়েছে- ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। জামায়াত গভর্নর নিয়োগ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসহ কয়েকটিতে নোট অব ডিসেন্ট দিলেও সবকটির বাস্তবায়ন চায়। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া ইসলামী আন্দোলনের একই অবস্থান। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। বিএনপি চায়, সাংবিধানিক সংস্কার আগামী সংসদে দুই বছরে হবে।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন মত দিয়েছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সংসদে সনদ অনুমোদন এবং তা গণভোটে গৃহীত হবে, যাতে কেউ বাতিল করতে না পারে।
গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে তৃতীয় দফার দ্বিতীয় দিনের সংলাপ হলেও কোনো দলই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরেনি। কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সাংবিধানিক আদেশ কিংবা গণভোটে সনদ বাস্তবায়নে মত দিয়েছে। তবে সরকার এখনই সেদিকে না গিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় গুরুত্ব দিচ্ছে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও আলোচনা চালিয়ে যেতে মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া দলগুলোর নেতারা বলেন, বিএনপি অভ্যুত্থানের পর অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ক্ষমতায় যাবেই-ধরে নিয়ে সংস্কারে বাধা তৈরি করেছে। এতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে সংবিধান সংস্কার করবে কিনা। নেতারা বলেন, উচ্চকক্ষের পিআর মানতেই হবে। উচ্চকক্ষে পিআরে রাজি করাতেই পুরো নির্বাচন এ পদ্ধতিতে করার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছে, যাতে আলোচনায় বিএনপিকে কিছু ছাড় দেওয়া যায়। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলে নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি বাদ দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দলগুলো নির্বাচনী কৌশল হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে হয়তো। আন্দোলন করা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। এ নিয়ে কিছু বলার নেই।’
সনদ নিয়ে আলোচনার চলমান অবস্থায় আন্দোলনকে বিএনপি কীভাবে দেখে-প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা দ্বিচারিতা বলা যেতে পারে।’ জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো দলকেই নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি। আইনে এখন দলের বিচারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারও আপত্তি থাকলে জাতীয় পার্টির বিষয়ে আদালতে যেতে পারে। আজ বুধবার আবার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। দুই দিনের বিরতিতে দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে কথা বলে মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান জানিয়েছিল কমিশন। আলোচনা হচ্ছে কিনা- এ প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেন, এমন উদ্যোগ তো দেখতে পাচ্ছি না। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, কারও ওপর চাপ তৈরি নয়; জুলাই অভ্যুত্থানকে সফল করতেই এ আন্দোলন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হতে হবে।
আন্দোলনে নির্বাচন অনিশ্চিত হতে পারে কিনা-এ প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ দলগুলো আন্দোলনে নেমেছে। চাপ কি শুধু সনদ বাস্তবায়নের, নাকি আসন ভাগাভাগির-বুঝতে সময় লাগবে।
জামায়াতের সংবাদ সম্মেলন: গত সোমবার রাজধানীর মগবাজারে আল-ফালাহ মিলনায়তনে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সংবিধানের অনেক বিধান অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি এবং জাতীয় ঐকমত্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের বৈধতার উৎস এবং ভিত্তি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এ বর্ণিত বিধানের জনগণের অভিপ্রায়। জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি সিদ্ধান্ত হয়েছে। জামায়াত সনদের আইনগত ভিত্তি চায়। আইনগত ভিত্তি ছাড়া অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। ডা. তাহের দাবি করেন, এখনও যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দাবি যেহেতু এক, তাই প্রতিটি দল নিজ নিজ জায়গা থেকে কর্মসূচি দিচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. তাহের বলেন, সংলাপে অংশ নেওয়া ৩১টির মধ্যে ২৫টি দল পিআরের পক্ষে। পার্থক্য হচ্ছে এসব দলের মধ্যে অনেকে উচ্চকক্ষে পিআর চেয়েছে; জামায়াত এবং আরও কিছু দল উভয় কক্ষে পিআর চেয়েছে। যেসব দল পিআরের পক্ষে, সবার সঙ্গে জামায়াত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে; আলাপ-আলোচনার জন্য না ডাকে, তাহলে ধীরে ধীরে কর্মসূচি দেওয়া হবে। যুগপৎ আন্দোলন থেকে জোট হতে পারে কিনা- প্রশ্নে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, জুলাই চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলোর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া নিয়ে নির্বাচন করা যায় কিনা, এটি নিয়ে আলোচনা চলছে। জুলাই সনদ বিষয়ে দুই ধরনের বিরোধিতা আছে। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি আইনগত। আইনগত বিষয়টি নিয়ে এখনও আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণেই কিছুটা আইনগত জটিলতা তৈরি হয়েছে। দাবি আদায়ে মাঠের কর্মসূচির কারণে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কার বিষয়ে ডা. তাহের বলেন, আরও পাঁচ মাস সময় আছে। এর মধ্যে জুলাই সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া, গণভোটের প্রয়োজন হলে তা সম্ভব। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম, হামিদুর রহমান আযাদ প্রমুখ।
চরমোনাই পীর দিলেন জোটের ইঙ্গিত: পুরানা পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ার কাছাকাছি রয়েছে। আগামী নির্বাচনে দেশ ও মানবতাপ্রেমীদের ভোট এক বাক্সে আনার একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। এনসিপিও এ আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছে দাবি করে চরমোনাই পীর বলেন, তারা আন্দোলন থেকে সরে যায়নি। তারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির ব্যাপারে একমত।
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে চরমোনাই পীর বলেন, একটি রাজনৈতিক পক্ষের আচরণে মনে হয়, অভ্যুত্থান হয়েছিল কেবলই ক্ষমতার পালা বদলের জন্য। এ পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। তাই জুলাইয়ের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছি। ফল না পেয়ে রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে।
জুলাই সনদ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, ভবিষ্যৎ স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করতে অপরিহার্য সংবিধান সংস্কারে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। একটি নির্দিষ্ট মহল থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা এসেছে।
নির্বাচনের পর সংস্কার বাস্তবায়নের কথায় আশ্বস্ত নন জানিয়ে রেজাউল করীম বলেছেন, নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখা দেখেছি। আইনি ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনের পর গালভরা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন আর হয় না। তাই যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের সার্বভৌম এখতিয়ার থাকে; সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ারবলে জুলাই সনদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের পর জাতীয় পার্টির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কাদের মধ্যে-এ প্রশ্নে চরমোনাই পীর বলেন, জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা করছে। একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে। পরিষ্কার করে বলতে চাই- জাতীয় পার্টি কোনো স্বাধীন রাজনৈতিক দল নয়। তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য এজেন্ট।
সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সোমবার পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো এ দলটিও নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের দাবি জানিয়ে অভিযোগ করে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ নয়। তারা সাংবিধানিক আদেশে সংবিধান সংস্কার এবং গণভোট দাবি করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *