ePaper

বাজারে দাম বেশি, সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকের অনীহা

নিজস্ব প্রতিবেদক
উত্তরের উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের জেলা নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং বগুড়ায় এবারের আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান থমকে দাঁড়িয়েছে। কৃষকরা খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বাজারে ধান-চালের দাম বেশি হওয়া এই সংকটের প্রধান কারণ। একইসঙ্গে গ্রামে গ্রামে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য এই সংগ্রহ অভিযানের জন্য অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লক্ষ্য পূরণে দুরূহ সংগ্রহ: এই জেলা ধান-চাল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমন ধান ও চাল সংগ্রহের অভিযান শুরু হয়। এই বছর ১৩ হাজার মেট্রিক টন আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ১ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। কৃষকরা বাজারে ভালো দাম পাচ্ছেন। যে কারণে সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নন তারা।
তিনি ২০ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন এবং এখন পর্যন্ত তার চার বিঘা জমির স্বর্ণা-৫ জাতের ধান কাটা ও মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। বাজারে প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৪২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা সরকারি দরের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারি দরে ধান বিক্রি করলে তাদের লোকসান হবে। এজন্য তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নন। কৃষক আব্দুল মতিন জানান, তিনি ২০ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন এবং এখন পর্যন্ত তার চার বিঘা জমির স্বর্ণা-৫ জাতের ধান কাটা ও মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। বাজারে প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৪২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা সরকারি দরের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারি দরে ধান বিক্রি করলে তাদের লোকসান হবে। এজন্য তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নন।
খাদ্যগুদামে যে ধান ৩৩ টাকা কেজি একই ধান ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি করতে পারছেন কৃষক। তাহলে কেন তারা কম দামে বিক্রি করবেন?
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার জানিয়েছেন, ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার মেট্রিক টন। আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। তবে জেলায় এবারে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্জন করা যাবে। দেড় মাসে সেখানে ধান সংগ্রহের চাহিদা ৫ হাজার চারশ ৩৩ মেট্রিক টনের বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮৪ মেট্রিক টন। সরকারি দরের চেয়ে বাইরে ভালো দাম পাওয়ায় জেলার কৃষকদের মিলারের কাছে ধান বিক্রিতে আগ্রহ নেই। জেলার ৩৯১ মিলারের মধ্যে এবার খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ২৮৫টি মিল। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চড়া দামে ধান সংগ্রহ করছেন। সিন্ডিকেটের অবৈধ প্রভাব ও মজুত নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের অভিযান থাকলেও উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই।
সিন্ডিকেটের অবৈধ প্রভাব না থাকলেও বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকারি দামের চেয়ে মণপ্রতি ৫০-১০০ টাকা বেশি দিয়ে কিছুটা ভেজা ধান সংগ্রহ করছে। আমাদের দর একদিকে তুলনামূলক কম, অন্যদিকে আর্দ্রতার ১৪ শতাংশের বেশি গ্রহণ করা হয় না। এছাড়া মিলারদের কাছে আনতেও অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয় ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকদের। যে কারণে সরকারি দপ্তর বা গুদামে এনে ধান-চাল বিক্রিতে তাদের আগ্রহ বেশ কম।
জেলা মিলার্স মালিক সমিতির উপদেষ্টা আব্দুল মোতালেব বলেন, সরকারি দরের চেয়ে ধান মণপ্রতি ৭০-৮০ টাকা এবং চাল কেজিপ্রতি ৫-৬ টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। যে কারণে এবারের মিলারদের ক্রমাগত লস হওয়ায় আগ্রহ কম। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হারুন-অর-রশিদ বলেন, সিন্ডিকেটের অবৈধ প্রভাব না থাকলেও বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকারি দামের চেয়ে মণপ্রতি ৫০-১০০ টাকা বেশি দিয়ে কিছুটা ভেজা ধান সংগ্রহ করছে। আমাদের দর একদিকে তুলনামূলক কম, অন্যদিকে আর্দ্রতার ১৪ শতাংশের বেশি গ্রহণ করা হয় না। এছাড়া মিলারদের কাছে আনতেও অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয় ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকদের। যে কারণে সরকারি দপ্তর বা গুদামে এনে ধান-চাল বিক্রিতে তাদের আগ্রহ বেশ কম।
সেখানে ধানের দাম বস্তাপ্রতি (৮০ কেজি) ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। মৌসুমের শুরু থেকে দাম বাড়ার কারণে অন্যবারের মতো কোনো সিন্ডিকেট কাজে লাগাতে পারেনি। এতে ঝামেলা ছাড়াই কৃষক লাভবান হচ্ছে। এবার সেখানে ৩৩ টাকা কেজি দরে ৪ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন ধান এবং ৪৭ টাকা দরে মিলারদের কাছে ৯ হাজার ৫৫৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গত সপ্তাহ পর্যন্ত জেলায় ধান সংগ্রহ হয়েছে ৮১ মেট্রিক টন। আর চাল সংগ্রহ ৭ হাজার মেট্রিক টন। নিজের ক্ষতি করে হলেও সরকারকে যথাসাধ্য চাল দিচ্ছি। না দিলে আমাদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি রয়েছে। তবে ধানের যে দাম, তাতে আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে চাল তৈরি এবং সরকারের কাছে দিতে। সরকার একটু বেশি রেট দিলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো।
জেলার হাট-বাজারগুলোতে বর্তমানে ৮০ কেজি মোটা জাতের ধানের বস্তা ২ হাজার ৮৫০-২ হাজার ৯০০ টাকা, চিকন ৩ হাজার ৩০০-৩ হাজার ৩৫০ টাকা ও কাটারি ধান ৩ হাজার ৯০০-৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা বাজারে ধান নিয়ে আসার আগেই রাস্তায় তারা যে দাম চাচ্ছেন দরদাম না করে ব্যবসায়ীরা সেই দামেই নিচ্ছেন।
ইটাখোলা বাজারে ধান বিক্রি করতে আসা রেজাউল করিম বলেন, গুদামে ধান দিলে ৩৩ টাকা কেজি পাওয়া যাবে, আর বাজারে সেই ধান ৪০ থেকে ৪১ কেজি দরে বিক্রি করছি। আবার গুদামে গেলে অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়। এত সবের দরকার কী। তার চাইতে বাজার অনেক ভালো।
জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি লায়েক আলী জানান, নিজের ক্ষতি করে হলেও সরকারকে যথাসাধ্য চাল দিচ্ছি। না দিলে আমাদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি রয়েছে। তবে ধানের যে দাম, তাতে আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে চাল তৈরি এবং সরকারের কাছে দিতে। সরকার একটু বেশি রেট দিলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো। জয়পুরহাট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন বলেন, ধানের দাম বাজারে বেশি পাওয়ায় মূলত কৃষকরা গুদামে ধান দিতে অনাগ্রহী। তবে চালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। গত সোমবার পর্যন্ত ধান বরাদ্দের ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং চাল ৭০ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে।
বগুড়া জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান-চাল উৎপাদন হয় শেরপুর উপজেলায়। এবার সেখানেও সংগ্রহ অভিযানে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এবার ৮ হাজার ৭৫৫ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৫৪টি চালকলের বিপরীতে মাত্র ৪ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের চুক্তি হয়েছে। বাকি মিলাররা চুক্তি করছেন না এবং কৃষকরাও গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নয়।
কৃষকরা বলেন, তারা বাজারে বেশি দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন, যা গুদামে বিক্রি করলে প্রায় ৩ টাকা কেজি লোকসান হতে পারে। ফলে তারা বাজারে বিক্রি করাই ভালো মনে করছেন। স্থানীয় মিলাররা জানিয়েছেন, গুদামে ধান ও চাল জমা দিতে গেলে তাদের ওপর বাড়তি খরচ পড়ছে। ফলে সরকারি দরে চাল বিক্রি করতে আগ্রহী নয় তারা। সরকারি খাদ্য সংগ্রহ অভিযান ব্যাহত হওয়ার পেছনে কৃষকদের বাজারে ধানের দাম বেশি পাওয়ার বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাদের বক্তব্য হলো সরকারি খাদ্যগুদামে ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ আরও সমতাভিত্তিক হলে, হয়তো কৃষকরা সরকারি সংগ্রহ অভিযানে অংশ নেবেন।
মির্জাপুর ইউনিয়নের সাগরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিম বলেন, আমরা সরকারি গুদামে এর আগে ধান দিয়েছি। সেখানে যে পরিমাণ ঝামেলা- ধান শুকানো, পরিষ্কার করে নেওয়া, তাতে এখন গুদামে দেওয়ার চেয়ে বাজারে বিক্রি করলে অনেক বেশি দাম পাওয়া যায়। এখন বাজারে এক মণ (৩৮ কেজিতে মণ) ধানের দাম এক হাজার ৫০০ টাকা অর্থাৎ কেজি ৩৮ টাকা। শেরপুর থানা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলিমুল ইসলাম হিটলার বলেন, কেজিতে ২-১ টাকা লোকসান হলেও লাইসেন্স রক্ষায় সরকারকে চাল দিতাম কিন্তু এখন যে হারে লোকসান হচ্ছে তাতে কোনো অবস্থায়ই এই লোকসান করা সম্ভব হবে না। এমনকি অনেক মিলার সরকারের সঙ্গে চুক্তির সময় যে টাকার বিডি করেছেন সেই বিডির টাকা বাতিল হলেও চাল দিতে পারবেন না। শেরপুর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, দুই গুদাম মিলে এখন পর্যন্ত মাত্র ৯২ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে, এখনো কোনো ধান কিনতে পারিনি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মামুন-এ-কাইয়ুম বলেন, বর্তমান বাজারদরের সাথে সরকার নির্ধারিত বাজারের তারতম্য থাকায় মিলার ও কৃষকরা ধান চাল দিতে চাচ্ছে না। আমরা সব সময় মিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি যেন তারা সঠিক সময়ে চাল দিতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *