ePaper

নড়াইলে বৃক্ষপ্রেমির অনন্য দৃষ্টান্ত

মির্জা মাহামুদ হোসেন রন্ট, নড়াইল

প্রতিদিন সকাল হলেই তারা বেরিয়ে পড়েন পথে প্রান্তরে। হাতে থাকে শাবল, কাচি, বাঁশের লাঠি ও দড়ি। কখনও বৃক্ষরোপন করছেন, কখনও এগুলোর আগাছা পরিষ্কার এবং পরিচর্যা করছেন। গবাদিপশু থেকে রক্ষার্থে খাঁচা দেয়া, পলিথিন দিয়ে গাছের গোড়া মোড়ানো, পানি দেয়া সবই করে থাকেন। বাঁশের খুঁটি পচে গেলে আবার দেয়ার ব্যবস্থা করা, কোন গাছ মরে গেলে নতুন গাছ রোপনের ব্যবস্থা করছেন। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো বিদেশী বা দ্রুত বর্ধনশীল গাছ রোপন করেন না। বছরের প্রায় ১২ মাসই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিরলনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা নিরবে নিজেদের অর্থ ও শ্রমে শহরের শোভাবর্ধন, পরিবেশের ভারসাম্য এবং পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে এসব গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন। নড়াইল সরকারি বালক ও বালিকা বিদ্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, আদালত চত্ত্বর, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ, নড়াইল ফেরীঘাট, নড়াইল শহরের ৪ লেন সড়কের দু’পাশে চোখে পড়বে এসব গাছের সারি। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তারা এসব গাছ রোপন করে চলেছেন। বিভিন্ন গাছের মধ্যে রয়েছে বট-পাকড়, তাল, আম, জাম, কাঁঠাল, কদবেল, বেল, কাঠ বাদাম, চালতে, আমড়া, জামরুল, আমলকি, অর্জুন, হরিতকি, পলাশ, কদম, বকুল ইত্যাদি। বৃক্ষপ্রেমি এ মানুষরা হলেন, নড়াইল শহরের যাযাবর মনির, খন্দকার আল মুনসুর বিল্লাহ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুন্সী কামরুজ্জমান বুলবুল, পরিবেশ কর্মী শাহ আলম, নজরুল ইসলাম সেখ, অ্যাডঃ অলিউল মাসুদ কোটন, অ্যাডঃ ইমরান, ইমন, আমিনুল হাসান মিঠু প্রমুখ। এদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রুপ নিয়ে আবার কেউ স্বতন্ত্রভাবে এসব গাছ লাগিয়ে থাকেন। বৃক্ষপ্রেমিরা পৃথকভাবে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে গাছ রোপন করেন। এর মধ্যে যাযাবর মনির দীর্ঘ ২৭ বছর একা নিজের মতো করে কাজ করেছেন। এর পর ৫ বছর আগে থেকে শাহ আলমের সাথে কাজ করেছেন। গত বছর থেকে অ্যাড. ইমরান ও ইমন রহমানের সাথে কাজ করছেন। যাযাবর মনির বলেন, আমার মা গাছ খুব পছন্দ করতেন। শৈশব অবস্থায় মা মারা যান। তাঁর বিদেহী আত্নার শান্তি কামনায় আমি ৯১ সাল থেকে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত নড়াইল শহরসহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ১২ হাজার ফলজ, বনজ ও ঔষধী গাছ লাগিয়েছি। এর মধ্যে বট-পাকড় ৬৫টি যার প্রায় ৬০ ভাগ বেঁচে রয়েছে। তালগাছ লাগিয়েছি প্রায় ৩ হাজার। যতদিন বাঁচবো ততদিন এভাবে গাছ লাগিয়ে যাব। তিনি বলেন, বর্তমানে বাকি যে গুপগুলো কাজ করছেন তারা বৃক্ষ রোপনের বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। আমি আমার মতো সবাই এভাবে এগিয়ে আসুক। খন্দকার আল মুনসুর বিল্লাহ, মুন্সী কামরুজ্জমান বুলবুল এবং নজরুল ইসলাম এক সাথে কাজ করেন। তবে চাকরির কারণে নজরুল ইসলাম অন্যত্র চলে যাওয়ায় মুনসুর বিল্লাহ ও কামরুজ্জমান বুলবুল একসাথে কাজ করছেন। প্রচার বিমুখ পরস্পর বন্ধু খন্দকার আল মুনসুর বিল্লাহ এবং মুন্সী কামরুজ্জমান বুলবুল জানান, ক্লান্ত পথিক দেশী গাছের নীচে একটু আশ্রয় নিবে, গাছে গাছে পাখিরা বসবে, ফল খাবে, সাধারন মানুষও ফল পেড়ে খাবে, এ ধরণের স্বপ্ন নিয়ে সড়কের দু’পার্শ্বে প্রায় ২৫ পূর্ব থেকে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার গাছ লাগিয়েছি, বেঁচেছে প্রায় ৪’শ। তাদের রোপন করা প্রায় তিন’শ গাছে ফল ও ফুল ধরেছে। তবে এর মধ্যে নড়াইল-রূপগঞ্জ সড়ক ৪ লেন করায় ২০২৪ সালে শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। প্রথমে অভিজ্ঞতা না থাকায় লাগানো অধিকাংশ গাছই বাঁচতো না। গাছের পেছনে প্রায় সারা বছর দেখভাল করা, পরিচর্চা এবং সময় না দিলে গাছ বাঁচে না। এ বছর ২০টির মতো গাছ রোপনের কাজ শুরু করেছি। নিঃশ্বার্থ বৃক্ষপ্রেমিদের একজন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নড়াইল জেলা শাখার সভাপতি শাহ আলম অ্যাডঃ অলিউল মাসুদ কোটন ও আমিনুল হাসান মিঠু এই তিন জন একসাথে কাজ করছেন। তবে শাহ আলম যাযাবর মনিরেও সাথেও কখন কখনও কাজ কাজ করেন। শাহ আলম বলেন, আমাদের দেশের পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য যে বনায়ন প্রয়োজন সে তুলনায় হচ্ছে না। এ ছাড়া পাখিদের খাদ্যের অভাবে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গাছের ফল একদিকে যেমন মানুষ খাচ্ছে আবার পাখিদেরও খাদ্যের চাহিদা মিটছে। নড়াইলে অনেকেই তাদের অর্থ এবং নিঃশ্বার্থ শ্রমে গাছ রোপন করছেন। এদেরকে উৎসাহ দেবার জন্য আমি গাছ রোপনের কাজ করে যাচ্ছি। এটা দেখে নড়াইলের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষও বৃক্ষরোপনে উৎসাহিত হচ্ছেন। এ ব্যাপারে নড়াইলের ফরেস্ট রেঞ্জার কাজী ইশতিয়াক রহমান বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তারা যদি আমাদের কাছ থেকে গাছের চারা নিতে চান তাহলে তাঁদেরকে গাছ দিয়ে আমরা সহায়তা করবো। এ ব্যাপারে নড়াইল জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জাহান বলেন, নড়াইলে নিঃশ্বার্থভাবে যারা গাছ রোপন করছেন তাদের বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে আগামিতে বৃক্ষ মেলায় পুরস্কৃত করা যেতে পারে। কারন তারা নিঃশ্বার্থভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *