ePaper

চুয়াডাঙ্গায় জমে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট

আহসান আলম, চুয়াডাঙ্গা

চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট। সরোজগঞ্জ বাজার থেকে একটু ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। প্রায় ৩শ’ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের এ হাটের নামডাক দেশজুড়ে। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। প্রতিবছরের মতো এবারও দেশের বৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট জমে উঠেছে সরোজগঞ্জে। গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন বেপারিরা। সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার বসে এ হাট। খেজুরগাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে তৈরি ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য প্রায় ৩শ’ বছরের। চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে প্রাঙ্গণে এই হাটটির অবস্থান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেঁচাকেনা। প্রতি সপ্তাহে প্রায় কয়েক কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়। মাটির হাড়ির বা ভাঁড়ের আকার ও ওজন ভেদে দাম ওঠানামা করে। মান ভেদে একভাঁড় গুড় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। অন্যান্য বারের তুলনায় এখানকার খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশি থাকায় দামও বাড়ছে। পুরো এলাকাজুড়ে সাজানো খেজুর গুড়ভর্তি মাটির ভাঁড় ও ছোট ছোট ধামা-কাঠায় নলেন পাটালি। ক্রেতা-বিক্রেতারা তা দাঁড়িয়ে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে ওজন করে ভর্তি করা হচ্ছে ট্রাক। আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিনছেন। হাটের প্রবেশপথের দু’ধারে বসে কৃষকেরা ধামা-কাঠায় করে তাদের বাড়িতে তৈরী পাটালি বিক্রি করছেন। পাটালির দোকান পার হয়ে ভেতরে যত যাওয়া যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ততই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। হাটের একাধিক স্থানে দাঁড়িপাল্লায় গুড় মেপে হাটে ভেড়ানো ট্রাকগুলোতে গুড়ের ভাঁড় তুলে সাজানো হয়। আগামী চৈত্র মাস পর্যন্ত চলবে বেচাকেনা। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এ হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুড় কিনতে সরোজগঞ্জের হাটে আসেন ব্যাপারীরা। চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৯৮ হাজার ৫০০টি খেজুর গাছ রয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৪৫ হাজার ৫১০টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ৯ হাজার ২০০টি, জীবননগর উপজেলায় ৩৭ হাজার ৪৫০টি গাছ থেকে রস নামানো হয়। এবার জেলায় গুড়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। জিল্লুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, গুড়ের দাম বেড়েছে। এখন প্রতি ভাঁড় (গুড় রাখার পাত্র) গুড় ২ হাজার ৪০০-২ হাজার ৬০০ টাকা। তবে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় গুড়ে ভেজাল বন্ধ হয়েছে। এ হাটের ঝোলা গুড়-নলেন গুড় ও পাটালি সারা দেশে বিখ্যাত। পাবনা থেকে আসা শহীদুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, এবার গুড়ের দাম বেশি কিন্তু সরবরাহ কম। তবে গুড়ে ভেজাল নেই। এছাড়া এ হাটে ব্যাপারীরা বেশ নিরাপত্তা পায়। কিন্তু ইচ্ছেমতো গুড় কিনতে পারছি না। ঢাকা থেকে গুড় কিনতে এসেছেন বিল্লাল হোসেন তিনি জানান, দেশের অন্যান্য হাটে এখানকার চেয়ে কম দামে গুড় পাওয়া যায়। তবে, সেসব গুড়ে চিনি মেশানো থাকে বলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কেউ তা কেনেন না। বেশি দাম জেনেও ব্যাপারীরা ভালো গুড় কিনতে চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জেই ছুটে আসেন, ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের একটি গুড়ের ভাঁড় ১ হাজার ৫শ’ থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। তবে, এই হাটে আমরা নিরাপত্তা সহকারে গুড় কিনতে পারি। কুতুবপুর ইউনিয়নের সাহেব নগর গ্রামের গুড়ের ক্রেতা বদরুউদ্দীন জানান, আমরা এই সরোজগঞ্জ বাজারে বহুদিন ধরে গুড় কিনে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকি, যেমন ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ফরিদপুর, টেকের হাটসহ বিদেশেও রপ্তানি করে থাকি, তবে এবার গুড়ের বাজার ভাল, গাছি বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে কেননা পুরাতন গাছি যারা তারা অনেকেই মারা গেছে যুবক ছেলেরা কেহ নতুন গাছি হচ্ছে না তাই গাছি কুমে গেছে সে ক্ষেত্রে বাজারে গুড় কম আসতে শুরু করেছে। এবাজার থেকে প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ টি ট্রাক লোড হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। সরোজগঞ্জ গুড়ের হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবীন নগর গ্রামের গাছি জহিরুল ইসলাম জানান, আমি প্রায় ৪০টি গাছের রস সংগ্রহ করি, প্রায় ২১ বছর ধরে এই হাটে গুড় নিয়ে আসছি। আমাদের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা গুড় কিনে নিয়ে যায়। তবে, গুড়ের ভাড়ের দাম বেড়েছে, এ কারণে অনেক সময় কম লাভ হয়। সরোজগঞ্জ গুড়ে হাটের শ্রমিকের সদ্দার খাইবার আলী বলেন, আমরা ব্যাপারীদের গুড় টানার কাজ করি ও ট্রাক গুড় লোড করি এবং সরোজগঞ্জ বাজারে প্রতি হাটে আয় হয় ৭০০-৮০০ টাকার মতো। এ কাজ করে সংসার ভালোই চলছে। সিলেট থেকে গুড় কিনতে আসা ভবতোষ কুমার বলেন, ‘গতবারের তুলনায় গুড়ের দাম বেশি। তবে দাম বেশি হলেওএই হাটের গুড়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। গুড় ভেজালমুক্ত হওয়ায় কদর বেশি। চিনি বা কোনো রাসায়নিক উপাদান নেই।’ ভেজালমুক্ত গুড় কেনার জন্যই এই হাটে আসা। সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাটের সংশ্লিষ্টরা জানান জানান, সরোজগঞ্জ বাজারে প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় সরোজগঞ্জ হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা তাদেরকে নিরাপদ দেয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এ হাটে গুড় কেনাবেচা শুরু হয়েছে। গতবারের তুলনায় জেলায় গুড় উৎপাদন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখানে স্থানীয় কৃষকরা পরম যত্নে চিনিমুক্ত গুড়-পাটালি উৎপাদন করে হাটে বিক্রি করে থাকেন। এ কারণে গুড়ের চাহিদা বেশি। আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের দিকেও নজর রাখছি। কেউ ভেজাল বা চিনিযুক্ত গুড়-পাটালি বিক্রি করলে তাদের ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, চলতি বছরে এ জেলায় গুড় বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭শ’ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে ৫৪ কোটি টাকার গুড় বিক্রি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *