ePaper

চড়া দামে ছোট হচ্ছে সোনার বাজার

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

এক ভরি সোনার অলংকার কিনতে গুনতে হচ্ছে দুই লাখ টাকার বেশি (ভ্যাট-মজুরিসহ)। চড়া দামে ক্রমে ছোট হচ্ছে সোনার বাজার। স্বর্ণালংকার এখন অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ক্রেতাদের আনাগোনা কম। ক্রেতা সংকট দেখা দেওয়ায় দেশে সোনার বাজারের আকারও ছোট হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সোনার অলংকার ব্যবসায় মন্দা চলছে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকেই। গত পাঁচ বছরে দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। বিপরীতে সোনার দাম বেড়েছে হু হু করে। ফলে বিক্রি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে সোনার অলংকার বিক্রি কমেছে ৮০ শতাংশের মতো। উৎসব-পার্বণে মানুষ এখন আগের মতো সোনার অলংকার কিনছে না। শখের বশে সোনার অলংকার কেনাও অনেকটা বন্ধ। একেবারে বাধ্য না হলে কেউ জুয়েলারিমুখী হচ্ছে না। বিক্রি না থাকায় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ছোট করছেন ব্যবসার আকার।

সোনার দামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো বিশ্বে অল্প কয়েকজন সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের বেশিরভাগ ইসরায়েলি ব্যবসায়ী। বাংলাদেশি তো দূরের কথা, এশিয়ার কোনো ব্যবসায়ীও এ তালিকায় নেই।- বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া তারা বলছেন, সোনার ব্যবসা এখন আর সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে নেই, জুয়াড়িদের দখলে চলে গেছে। একদল সোনার বাজারকে এখন জুয়ার দানের মতো ব্যবহার করছেন। ফলে সোনার দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশে সোনার বাজারের প্রকৃত আকার কত, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা বা জরিপ কেউ করেনি। তবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) এক প্রতিবেদনে দেশের সোনার বাজারের আকার দুই লাখ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। বর্তমান বাজার এর চেয়ে ২০ শতাংশের মতো কমেছে বলে জানান বাজুসের দায়িত্বশীলরা। সে হিসাবে বর্তমানে দেশে সোনার বাজারের আকার এখন দেড় লাখ কোটি টাকার মতো। অনেকেই ঠিকমতো কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না। তবে ব্যবসা মন্দা গেলেও আমাদের কোনো সদস্য ব্যবসা বন্ধ করেননি। কিন্তু অনেকেই ব্যবসার পরিসর ছোট করে ফেলেছেন। সামনে ব্যবসার পরিসর আরও ছোট হতে পারে।- বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিশ্ববাজারেও সোনার দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। হু হু করে বেড়ে মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) প্রতি আউন্স সোনার দাম রেকর্ড তিন হাজার ৬৯১ ডলারে ওঠে। অতীতে বিশ্ববাজারে সোনার এত দাম কখনো দেখা যায়নি। এমনকি চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) আগে এক আউন্স সোনার দাম কখনো তিন হাজার ৬শ ডলার হয়নি। গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রথমবার এক আউন্স সোনার দাম তিন হাজার ৬শ ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়ে বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে দেশের বাজারেও সোনার রেকর্ড দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম এক লাখ ৮৯ হাজার ৬২২ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনা এক লাখ ৮২ হাজার ২ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনা ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনার এই দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করে সোনার অলংকার বিক্রির নিয়ম করা হয়েছে। এতে ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনায় ভ্যাট নির্ধারিত হয়েছে ৯ হাজার ৪৮১ টাকা। আর মজুরি ১১ হাজার ৩৭৭ টাকা। ফলে ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনা কিনতে ক্রেতাদের ২ লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা গুনতে হবে।

সোনার দামের যত রেকর্ড

বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ভালো মানের এক ভরি সোনার দাম ছিল ৬ হাজার ৯শ টাকা। এরপর কয়েক দফা বেড়ে ২০১০ সালে ৪২ হাজার ১৬৫ টাকায় ওঠে। দেশে এক ভরি সোনার দাম প্রথম ৫০ হাজার টাকা হয় ২০১৮ সালে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এক ভরি সোনার দাম ৬০ হাজার ৩৬১ টাকায় ওঠে। দেশের বাজারে এক ভরি সোনার দাম প্রথম এক লাখ টাকা হয় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি এক ভরি সোনার দাম প্রথমবার ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মাইলফলক স্পর্শ করে। এদিকে গত বছরের শুরুতে ভালো মানের এক ভরি সোনার দাম ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকা। বছর শেষে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। এ হিসাবে ২০২৪ সালে সোনার দাম বাড়ে ২৫ শতাংশ এবং চলতি বছরের সাড়ে নয় মাসে দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে সোনার দাম বেড়েছে ২১৪ শতাংশ। অন্যভাবে বলা যায়, সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে সোনার দাম বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।প্রতিদিন আসে ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনা

বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারাদেশের পানি, স্থল ও আকাশপথে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে, যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *