চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে

জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্র ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বা এনসিটিতে এই ক্রেন দরকার ১২টি। আছে ১৪টি। আবার জাহাজ থেকে নামানোর পর কনটেইনার স্থানান্তরের যত যন্ত্র দরকার, তারও সবই আছে টার্মিনালটিতে। টার্মিনালটিতে জাহাজ থেকে বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। দেশীয় অপারেটর গত বছর এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ করেছে। এভাবে টানা ১৭ বছর ধরে দেশীয় প্রতিষ্ঠান দিয়ে চালানো হচ্ছে টার্মিনালটি।

প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে এবং ভালোভাবে চলতে থাকা এই টার্মিনাল আওয়ামী লীগ আমলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ আমলের সেই ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরে সরব বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা। আন্দোলন-বিক্ষোভও করছেন তাঁরা। আন্দোলনে থাকা নেতাদের একজন হুমায়ুন কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের টাকায় জেটি নির্মিত হলো। যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে দেশের টাকায়। বন্দর ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান মিলে টার্মিনালটি ভালোভাবে পরিচালনা করছে। বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয় হচ্ছে এই টার্মিনাল থেকে। ১৭ বছর পর এই টার্মিনাল কেন এখন বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হবে? তিনি বলেন, ‘বিদেশিরা যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে বে টার্মিনালে আসুক, যেখানে আমরা কোনো কিছুই করিনি। এখানে নয়।’

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫০ মিটার লম্বা নিউমুরিং টার্মিনাল সবচেয়ে বড়। গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানো-নামানো হয়েছে এই টার্মিনালে। একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলরত একটি ছোট জাহাজ ভিড়ানো যায় তাতে।

এই টার্মিনালের চেয়ে ছোট আরও তিনটি টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে নিউমুরিং টার্মিনালের পাশে চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) গত বছর ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবিতে ৩৭ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়। এর বাইরে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল গত বছরের জুনে চালু হয়। তারা এখন যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। তবে পুরোদমে এখনো চালু হয়নি।

বিদেশিরা যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে বে টার্মিনালে আসুক, যেখানে আমরা কোনো কিছুই করিনি। এখানে নয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২৩ সালের মার্চে নিউমুরিং টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এই প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)।

গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভায় প্রকল্পের টাইমলাইন ঠিক করা হয়। নথি অনুযায়ী, আগামী মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট বা টিএসআর প্রদান করবে। এই প্রতিবেদন অনুমোদনের পর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকুয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। দর-কষাকষি করে নভেম্বরে কনসেশন চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রকল্প অনুযায়ী, চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড।

একটি পক্ষ মনে করছে, বন্দর পরিচালনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের রয়েছে বিশ্বমানের দক্ষতা। নিউমুরিং টার্মিনালে খুব বেশি বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলেও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। টার্মিনালের আয়-ব্যয়ের চেয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চায় এই পক্ষ।

বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া জোরালো হওয়ার পর আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। তাঁদের উদ্বেগ, বন্দরের এই টার্মিনাল সবচেয়ে বড়। এতে শ্রমিক-কর্মচারী মিলে এক হাজারের মতো কর্মরত রয়েছেন। বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলে চাকরি হারাতে হবে শ্রমিকদের। আবার বন্দরের আয় কমে যাবে। যদিও নৌ উপদেষ্টা আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করে আসছেন, কারও চাকরি যাবে না।

২০০৭ সাল থেকে আংশিক এবং ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্রের মাধ্যমে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে টার্মিনাল পরিচালনা কাজের ভার দিয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত শ্রমিকেরা ছাড়াও টার্মিনালটিতে কাজ করছেন বন্দরের কর্মচারীরাও।

নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। কারও চাকরিও যাবে না। যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটি দেশের স্বার্থেই নেওয়া হবে। এখানে ব্যক্তিগত লাভের কোনো বিষয় নেই। দেশের স্বার্থই বড় করে দেখা হচ্ছে।

নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন

বন্দরের হিসাবে, টার্মিনালটিতে ২২-২৩ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছে ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। এ সময়ে বন্দর টার্মিনাল পরিচালনার জন্য যে প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেছে, তারা কনটেইনারপ্রতি বিল পেয়েছে ৬৯৪ টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ ডলার। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রকৃত আয় হয়েছে ৫৭৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে কনটেইনারপ্রতি বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ ডলার।

এখন বন্দর টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আয় নির্ভর করবে দর-কষাকষির ওপর। বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনালে বন্দর পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি ১৮ ডলার করে। সেখানে বন্দরের শুধু জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ রয়েছে। নিউমুরিং টার্মিনালে কনটেইনারপ্রতি এই আয় বাড়বে। তবে এখন যা আয় করছে, তার চেয়ে অনেক কম হওয়ার শঙ্কাই বেশি।

একটি পক্ষ মনে করছে, বন্দর পরিচালনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের রয়েছে বিশ্বমানের দক্ষতা। নিউমুরিং টার্মিনালে খুব বেশি বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলেও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। টার্মিনালের আয়-ব্যয়ের চেয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চায় এই পক্ষ।

সরকার কী ভাবছে, বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

প্রকল্পের টাইমলাইন অনুযায়ী এগিয়ে চলছে নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কাজ। তবে এখনো অনেক ধাপ বাকি রয়েছে। অর্থাৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

নিউমুরিং টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। কারও চাকরিও যাবে না। যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটি দেশের স্বার্থেই নেওয়া হবে। এখানে ব্যক্তিগত লাভের কোনো বিষয় নেই। দেশের স্বার্থই বড় করে দেখা হচ্ছে।

বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানও গত বৃহস্পতিবার বন্দর দিবসে এক মতবিনিময় সভায় বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে। তবে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান ও দক্ষতা বাড়বে এবং বড় অঙ্কের আর্থিক লাভ হবে। কারও চাকরি যাবে না। যেমন পতেঙ্গা টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার পরও ঊর্ধ্বতন কয়েকজন ছাড়া সব বাংলাদেশি জনবল সেখানে কাজ করছে।

বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো বন্দরের সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদেরই একজন বন্দর পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম বলেন, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। লালদিয়ার চর, বে-টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগের যে প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলো ভালো সিদ্ধান্তের উদাহরণ। কারণ, বন্দরের কোনো অবকাঠামো নেই সেখানে। তবে নিউমুরিং টার্মিনালের প্রেক্ষাপট পুরো ভিন্ন। এখানে যেহেতু বন্দরের সব অবকাঠামো আছে, টার্মিনালটিও ভালোভাবে চলছে। তাই এ টার্মিনাল দেশীয় প্রতিষ্ঠান দিয়েই চালানো উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *