রোকসানা পারভিন, (ফরিদপুর) আলফাডাঙ্গা
বাবা ছিলেন জুট মিলের শ্রমিক। বাবা-মা ও তিন ভাইয়ের সংসারে ছিল না সচ্ছলতা। বড় ছেলে রবিউল ইসলাম ওরফে রবি বা পায়ের সমস্যা নিয়েই জন্ম নিয়েছেন। শিশু বয়সে অসাবধনাতর জন্য ডান হাতে আঘাত পেয়ে হারিয়েছেন হাতের শক্তি। ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া রবিউল ইসলাম বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝে নিয়েছিল বাঁচতে হলে ভালো ভাবে পড়া লেখা শিখতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক প্রর্যন্ত পড়ালেখায় ভালো ফলাফল করায় চান্স পেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। চলে যান অচেনা শহরে কিছু দিনের মধ্যে অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে কয়েক বন্ধু মিলে বিভিন্ন মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন। এতে পড়ালেখার খরচ শেষে কিছু টাকা জমানো শুরু করেন। কিছু দিনের মধ্যে বেশ কিছু টাকা জমা হলে সহকর্মীরা কৌশলে সে টাকা আত্মাসাৎ করে নেয়। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯৭ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট অনার্স শেষ করেন। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে ব্যবসা করে বেশ টাকার মালিকও হয়ে গিয়েছিলেন। যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসায়ীক পাটনার কষ্টে অর্জিত টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। এ দিকে রবিউল হয়ে যায় পাগলপারা। মনের সাথে যুদ্ধ করে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০০ সালে আলফাডাঙ্গা সদর বাজারে একটি কম্পিউটার নিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেন। এসময় দুই একজন নিজের বিশেষ পরিচিতজনেরা প্রশিক্ষণ নেয়। ভালো কাজের দক্ষতা থাকায় ধীরে ধীরে ভীড় বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে কম্পিউটারের সংখ্যা। সমাজসেবা, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও যুব উন্নয়ন থেকে নিয়ে নেন অনুমোদন। ছোট দোকান বদল করে বড় ঘর ভাড়া নেন। নাম দিয়েছেন স্বর্ণিভর কম্পিউটারএখন তার কম্পিউটারের সংখ্যা ২১টি। তিনজন সহকারী প্রশিক্ষক রয়েছেন। সাত হাজার টাকা ঘর ভাড়া পরিশোধ করে, কর্মচারীদের বেতনসহ অন্যঅন্য খরজ বাদ দিয়ে রবিউল ইসলামের মাসিক আয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অল্প টাকায় ভালো প্রশিক্ষণ বিধায় সকাল-বিকেলে প্রশিক্ষণার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই যুগে তিন বিভিন্ন বয়সী তিন হাজার শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ নেওয়া অনেকেই বিভিন্ন বাজারে কম্পিউটারের দোকান দিয়ে কাজ করে পরিবার নিয়ে ভালো আছেন। আলফাডাঙ্গা সদর বাজারে এক হাত দিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যেমে ওয়াজ, গান, নাটক, সিনেমাসহ বেশ কিছু জিনিস মোমোরী কার্ড লোড দেন রুবেল শেখ বলেন, প্রাইমারী স্কুলে পড়ালেখা করার সময় আমার একটি দুর্ঘটনায় আমার ডান হাত হারাই। ডিগ্রি পাশ করে চাকুরী আশা ছেড়ে দিয়ে স্বণিভর থেকে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি কম্পিউটার ক্রয় করে দোকান ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। রবিউল ইসলামের বর্তমান বয়স ৪৯ বছর। বিবাহ করেছেন ১৯৯৬ সালে বিবাহ করেছেন। সংসার জীবনে দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে আলফাডাঙ্গা সরকারি কলেজে ডিগ্রি শাখার শিক্ষার্থী। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার প্রতিষ্ঠানে সময় দেন। কম্পিউটারে কোনো ত্রুুটি দেখা দিলে সমাধাণ করেন। একান্ত আলাপ চারিতায় সমকালকে রবিউল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে চাকুরী করানোর কোনো ইচ্ছে নেই। চাকুরীর পিছনে সময় ব্যয় না করে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাভলম্বী হবে তারা। সরকারের কাছ থেকে যদি সার্বিক কোনো বড় সহযোগীতা পাই তাহলে প্রতিষ্ঠানকে বড় করতে চাই। অসহায় শিক্ষার্থীদে বিনামূল্যে ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে সাবলম্বী করতে চাই। আলফাডাঙ্গা সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অর্নাস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুশনা খানম বলেন, আলফাডাঙ্গা স্বনির্ভর কম্পিউটার থেকে ইংলিশ স্পোকেন ও গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নেই। এরপর থেকে এলকার অনেক শিক্ষার্থীকে ইংলিশের ওপর কোচিং করানো শুরু করছি। সেই সাথে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে গ্রাফিক্স কাজ করছি। পড়ালেখার চাপ থাকার জন্য এখন কাজ করার সুযোগ কম। এখন প্রতিমাসে সবমিলে আমার ১০-১৫ হাজার টাকা আয় হয়। তবে ভবিষৎএ আশা করছি অনেক ভালো কিছু করতে পারবো। স্বর্ণিভর কম্পিউটার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে লাল মিয়া নামের এক যুবক বলেন, আমি ছোট একটি চাকুরী করে যে বেতন পাই আমার পরিবার নিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হতো। এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে তিন মাসের কম্পিউটারের কোর্স শেষ করি। এখন সরকারি-বেসরকারি অফিসের বিভিন্ন কাজ করে যে টাকা আসে আল্লাহর রহমতে সংসার ভালো ভাবে চলে যাচ্ছে। উপজেলার বেড়িরহাট বাজারের স্টুডিও ব্যবসায়ী মোবারক সিকদার বলেন, বিএ পাশ করে চাকুরীর জন্য অনেক স্থানে গিয়েছি ব্যর্থ হয়ে শেষে আলফাডাঙ্গা স্বর্ণিভর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ছয় মাসে একটি কোর্স শেষ করেছি। এখন দোকান করেছি আমার দিন অনেক ভালো যাচ্ছে। দোকানে পাঁচ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়ে একটি ছেলে রেখেছি। উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা একেএম মাসুদুল হাসান বলেন, রবিউল ইসলাম জীবনের অনেক সমস্যা সম্মুখিন হয়ে আজ নিজের পায়ে দাড়িয়েছে এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। যদি যুব উন্নয়ন থেকে কোনো ঋণ চায় তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তাকে সাহায্য সহযোগীতা করা যেতে পারে। আলফাডাঙ্গার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার এ.কে.এম রায়হানুর রহমান বলেন, রবিউল ইসলাম যেটা করছে সেটা সত্যিয় প্রশংসনীয় কাজ। তাকে সার্বিক সহযোগীতা করার আশ্বাস প্রদান করার কথা বলেন এই নির্বাহী কর্মকর্তা।