মোঃ নাজমুল হুদা, খুলনা
পশুর নদীর শান্ত বুকে দাঁড়িয়ে থাকা মোংলা সমুদ্র বন্দর যেন এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী। একসময় নিস্তরঙ্গ আর সীমিত সক্ষমতার এই বন্দরটি এখন রূপ নিচ্ছে আধুনিকতার এক দৃষ্টিনন্দন প্রতীকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত মোংলা বন্দর শুধু নৌ-যোগাযোগের কেন্দ্র নয়, দেশের অর্থনীতির জন্য হয়ে উঠছে শক্তিশালী চালিকাশক্তি।
বন্দরের নবজাগরণ: এক দশক আগেও মোংলা বন্দরে বড় জাহাজ ভিড়ানো ছিল কষ্টসাধ্য। সময় লাগত, খরচও বাড়ত। অথচ এখন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইনার বারে ড্রেজিংয়ের পর বন্দরে ১০ মিটারের বেশি গভীরতার জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারছে। এতে যেমন সময় বাঁচছে, তেমনি ব্যয়ও কমছে। শুধু তাই নয়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখানে ৮৩০টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ আগমন করেছে—যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড।
আধুনিক যন্ত্রপাতির স্পর্শ: মোংলা বন্দর আজ আর পুরনো দিনের মতো নয়। কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং এখন হয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, রিচ স্ট্যাকার, মোবাইল ক্রেন কিংবা টার্মিনাল ট্রাক্টরের মতো আধুনিক প্রযুক্তি বন্দরে এনে দিয়েছে গতি ও প্রাণচাঞ্চল্য। কার ইয়ার্ড, ওয়্যারহাউজ, কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ নতুন অবকাঠামো নির্মাণও চলছে। এসবের ফলে বন্দরের ধারণক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বিদেশি ব্যবসায়ীদের আস্থাও। নিরাপত্তার দিক থেকেও বন্দরের মান এখন আন্তর্জাতিক।
অর্থনীতি ও বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত: মোংলা বন্দরের উন্নয়ন শুধু বন্দরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রভাব পড়ছে পুরো অঞ্চলে। রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানির বড় অংশ এখন এই বন্দর দিয়েই খালাস হচ্ছে। একই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। এর ফলশ্রুতিতে রাজস্ব আয়েও রেকর্ড তৈরি করছে মোংলা বন্দর। একসময় যেখানে এই বন্দরকে তুলনামূলকভাবে কম কার্যকর বলা হতো, আজ সেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আয় করে দেশের অর্থনীতিতে যোগ করছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
কর্মসংস্থানের আলোকবর্তিকা: বন্দরকে ঘিরে আশেপাশের এলাকা জেগে উঠেছে নতুন শিল্পের আলোয়। ইপিজেড, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পকারখানার সমাহার গড়ে উঠছে একের পর এক। হাজারো মানুষের জীবিকা আজ নির্ভর করছে এই বন্দরের সাথে সম্পর্কিত কর্মসংস্থানের উপর। এ যেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ।
আঞ্চলিক বাণিজ্যের সেতুবন্ধন: বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে মোংলা বন্দর এখন হয়ে উঠছে আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্র। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রসারে এই বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হচ্ছে।
ভবিষ্যতের গ্রিন পোর্ট: চীন সরকারের সহযোগিতায় জিটুজি চুক্তির আওতায় দুটি নতুন কন্টেইনার টার্মিনালসহ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই- মোংলা বন্দরে একটি আধুনিক, স্বয়ংক্রিয় ও পরিবেশবান্ধব “গ্রিন পোর্ট” গড়ে তোলা। পদ্মা সেতু ও রেল যোগাযোগের সংযোজন বন্দরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা কিংবা উত্তরবঙ্গের সাথে যোগাযোগ এখন অনেক সহজ, দ্রুত ও কার্যকর। চলমান প্রকল্পগুলো শেষ হলে মোংলা বন্দর শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, ইউরোপ-আমেরিকার বাণিজ্যের সাথেও দৃঢ়ভাবে যুক্ত হবে।
বন্দরের আত্মবিশ্বাস: মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মোঃ মাকরুজ্জামান বলেন, এখন আর মোংলা শুধু রপ্তানি নির্ভর বন্দর নয়। এটি একটি গতিশীল বাণিজ্যকেন্দ্র। সরকারের বড় বড় মেগা প্রজেক্টের মালামাল এ বন্দর দিয়েই সফলভাবে আমদানির সক্ষমতা প্রমাণ করছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এর ভূমিকা অমূল্য।
সর্বশেষ কথা: একসময় পিছিয়ে থাকা মোংলা বন্দর এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার প্রতীক। আধুনিক অবকাঠামো, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা, রাজস্ব বৃদ্ধি আর কর্মসংস্থানের কারণে এটি ক্রমেই হয়ে উঠছে জাতীয় আস্থার জায়গা। বলা যায়, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে মোংলা বন্দর শুধু দেশের নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের মানচিত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে।
আধুনিকতার এক দৃষ্টিনন্দন প্রতীকে দৃশ্যমান হচ্ছে মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ
