লিয়াকত আলী, লালমনিরহাট
লালমনিরহাটে অবাধে চলছে ফসলি জমির ওপরের অংশ কেটে কেনাবেচা। মাটির ওপরের নরম অংশটিকে বলা হয় (টপ-সয়েল) যা উর্বরা শক্তিই ফসলি জমির একমাত্র প্রাণ। জমির প্রাণ খ্যাত এ অংশ কেটে নিয়ে পোড়ানো হচ্ছে ইটভাটায়। যা কোন ভাবেই রক্ষা করতে পারছেনা প্রশাসন। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না কৃষকের স্বপ্ন। জানা গেছে, মাটির ওপরের ৬/৭ ইঞ্চি টপ সয়েলেই থাকে জমির একমাত্র উর্বরা শক্তি। যে জমির উর্বরা শক্তি বেশি, সে জমির উৎপাদন ক্ষমতাও তত বেশি। চাষাবাদের সময় জমিতে প্রয়োগ করা জৈব ও রাসায়নিক সারের একটা বড় অংশ ফসল উঠলেও জমিতে থেকে যায়। যা পরবর্তী ফসল বোনার সময় বেশ কাজে লাগে। ফসলি জমির ওপরের অংশ কেটে নিলে ওই জমি শক্তিহীন ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তী কয়েক বছর ওই জমির উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায় এবং উচ্চমূল্যে চাষাবাদ করেও পূর্বের ন্যায় আশানুরূপ ফসল না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। শুকনো মৌসুম আসলেই এসব জমির ওপরের অংশের দুই/তিন ফুট পর্যন্ত মাটি প্রায় প্রতিনিয়তই কেটে নেওয়া হচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এসব জমির মাটি খুঁড়ে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। এ ক্ষেত্রে জমির মালিককে সামান্য কিছু অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন। এসব ব্যবসায়ীরা উঁচু জমি টার্গেট করে কৃষকদের ভুলভাল বুঝিয়ে রাজি করাচ্ছেন। তারা কৃষকদের বলছেন, উঁচু জমিতে পানি বেশি লাগে, তাই জমি নিচু করা দরকার। এসব ভুল তথ্য দিয়ে জমি খুঁড়তে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এ বছর যে জমির মাটি তুলে নিয়ে গভীর করছেন, পরের বছর তার পাশের জমির মালিকদেরও লোভ দেখাচ্ছেন। কারণ সর্বদাই নিচু জমিতে নেমে যায় পানি ও পলি। এ ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হচ্ছেন পার্শ্ববর্তী জমির মালিকরাও। এভাবেই ফসলি জমির প্রাণ কেটে নিয়ে প্রতিনিয়ত ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষকরা ব্যবসায়ীদের চটকদার কথায় রাজি হয়ে জমি খুঁড়ে মাটি দিচ্ছেন ইটভাটায়। ভাটার মালিকরা এসব মাটি নিয়ে তৈরি করছেন ইট। ভাটার মালিকরা এভাবে লাভবান হলেও অল্প কিছু নগদ টাকার লোভে জমির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। ফলে দিনদিন উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে এসব বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। জরিমানা গুণেও তারা চালিয়ে যাচ্ছেন এ ব্যবসা। ফলে জেলার উঁচু জমিগুলো প্রতিনিয়ত নিচু হয়ে যাচ্ছে এবং উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জেলার সব ইটভাটায় এসব ফসলি জমির উর্বরা অংশ মজুত রাখতে দেখা যায়। তবে এসব মাটি কারো কাছ থেকে জোর করে নেওয়া হয় না বলে দাবি ইট ভাটার মালিকদের। তারা বলছেন, জমির মালিকরাই টাকার বিনিময়ে মাটি বিক্রি করছেন। যা ইট তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে এসব মাটি কিনে নেন তারা। কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষে সচেতন মহলের প্রশাসনের কাছে দাবি, মাঝে মধ্যে ভ্রম্যমাণ আদালত নয় এ বিষয়ে সব সময় নজরদারি রাখা দরকার। জরিমানা না করে সাজার আওতায় আনলেই বন্ধ হবে এসব কাজ। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বলেন, জমির ওপরের ছয় থেকে আট ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত মাটির উর্বরা শক্তি থাকে। কোনো কারণে এ অংশ উঠে গেলে ওই জমির উর্বরা শক্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উৎপাদনও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। টপ সয়েল তুলে ফেললে জমি পুনরায় স্বাভাবিক হতে অন্তত পাঁচ/সাত বছর চাষাবাদ করতে হয়। এ দীর্ঘ সময়ে উৎপাদন কমে গিয়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ কারণে ফসলি জমির মাটি না তুলতে প্রতিনিয়ত কৃষকদের নিয়ে সচেতনতা মূলক সভা-সমাবেশ করা হচ্ছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রাকিব হায়দার এ বিষয়ে বলেন, কৃষকদের ফসলি জমির মাটি বিক্রি করতে বিভিন্ন ভাবে নিষেধ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করা হচ্ছে। কৃষকদের মাঝে সঠিক ভাবে সচেতনতামূলক সভা সমাবেশ করে এটা রোধ করতে হবে।