ePaper

অসতর্কতায় সাঁতার প্রশিক্ষণে শিশুর মৃত্যু

এম.এ আজিজ, ঠাকুরগাঁও ১১ অক্টোবরে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে, ঠাকুরগাঁওয়ে সাঁতারের প্রশিক্ষণের পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণার্থী আয়মান হোসেন নামে ৯ বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ছেলেটি তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান। শিশুদের জন্য সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যারা করেছিলেন তারা একটা ভালো পদক্ষেপই নিয়েছিলেন। এই ভালো কাজটার সফল সমাপ্তির জন্য যে সব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল সে সব বিষয়ে তাদের জ্ঞানের অভাব ছিল, না হলে এই ঘটনা ঘটার কথা নয়। সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে ৮ জন সাঁতারুর সাঁতার প্রতিযোগিতা পরিচালনা করতে বিচারক সহ ২০ মানুষের প্রয়োজন হয়। আর প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে আরো বেশী মানুষ প্রয়োজন হবে। কেননা এখানে বাড়তী কিছু কাজ করার লোক থাকতে হয়। তাদের কাজ দৃশ্যমান নয় কিন্তু লোক প্রয়োজন। সাঁতার প্রতিযোগিতা পরিচালনার জন্য সাধারণ খেলার মতো ব্যবস্থাপনায় চলেনা। মাইকে ঘোষণা দিয়ে অসংখ্য ছেলেমেয়েদের পুকুরে নামিয়ে দিয়ে সাঁতার প্রশিক্ষণের আয়োজন সঠিক হয়নি। যারা উপজেলার পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন তাদের যে এ বিষয়ে তেমন কোন ধারণা নাই সেটা সহজেই প্রমানিত হয়। সাংবাদিক বিশাল রহমান ফেসবুক পোষ্টে খুবই মৌলিক প্রশ্নটা তুলেছেন। বিশাল রহমান সাঁতার বিশেষজ্ঞ কিনা সে কথা বাদ দিলেও তিনি যা বোঝেন আয়োজনকারী সাঁতার বিশেষজ্ঞরা কেন জানবেননা এই প্রশ্নটা মিলিয়ন ডলারস কোশ্চেন। বঙ্গোপসাগরে বা পদ্মা নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যাবেনা। সাঁতার প্রশিক্ষণের পুকুর ৫০ মিটার লম্বা ২০ মিটার চওড়া হলেই সবচে ভালো হয়। পানির গভীরতা ৬ ফুট হলেই চলে। পানি পরিষ্কার হতে হবে। আর নিরাপত্তার বিষয়টা সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক না থাকলে যে সব দূর্ঘটনা ঘটতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ঠাকুরগাঁওয়ের এই দুর্ঘটনা। সাঁতারে মাসল পুল করার ঘটনা ঘটে। মাসল পুল করলে ১ গজও সামনে যাওয়ার উপায় নাই। বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে। প্রতি ১ জন সাঁতারুর জন্য একজন করে পর্যবেক্ষক থাকবে। পুকরে অবশ্যই লেন থাকবে এবং নির্বাচিত সংখ্যক পরিমান প্রশিক্ষণার্থী নামতে পারবে। প্রশিক্ষণ হবে ধারাবাহিক। সমমানের প্রশিক্ষনার্থী থাকতে হবে। একই সঙ্গে সাঁতার না জানা, এবং কম জানাদের একসাথে প্রশিক্ষণ করা যাবেনা। আরো বিষয়াদি আছে। এখন হয়তো তদন্ত কমিটি হবে। কয়েকমাস ধরে তদন্ত হবে এবং এই তদন্তের রিপোর্ট কোন দিন প্রকাশিত হবেনা সেটাও আমাদের জানা। হয়তো প্রমান করা চেষ্টা করা হবে, ছেলেটাকে পানি থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল সে আবার সবার অগোচরে পানিতে নেমেছে। এই “অগোচরে ” পানিতে নামার তো কোন সুযোগ নেই। সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের আকাঙ্খা থেকে কত বড়ো সর্বনাশটা হয়ে গেল। শারীরিক শিক্ষার প্রশিক্ষন নিয়েছিলাম দেশে বিদেশে। শারীরিক শিক্ষার ট্রেনিংয়ে সাঁতার একটি গুরুত্বপুর্ন স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে কোন খেলার খেলোয়ার হতে হলে তাকে আগে সাঁতারে কোয়ালিফাই করতে হবে। কারণ হলো সাঁতার হলো সবচে ভাল এক্সারসাইজ। সব অঙ্গ চালনা করতে হয়। পাশের দেশ ভারতে ফিটনেস গেম খো খো তে কোয়ালিফাই করতে হয় অন্য খেলার জন্য। খেলোয়ারতো হতে হবে ৫/৬ বছরে। আমাদের দেশে আমরা ১৬/১৭ বছর বয়সে খেলোয়ারদের রিক্রুট করি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সাঁতারে আমার ব্যক্তিগত দক্ষতা তেমন কোন পর্যায়ে পড়েনা। তবে সাঁতারের প্রতিযোগিতা কিংবা প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য খুঁটিনাটি বিষয়গুলি রপ্ত করতে হয়েছিল। কর্মজীবনে জেলা ক্রীড়া অফিসারের চাকুরী করতে গিয়ে বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসুচির আওতায় বছরে ১ টা করে প্রতিযোগিতা বা প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছি। চাকুরীর শেষের ৩ বছর সর্বোচ্য ৮ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকতো। এর মধ্যে ভ্যাট নামক একটা খড়গ ছিল। এর পর লেন তৈরি করতে হতো, লাইফ জ্যাকেটের প্রাপ্যতা যাও বা ছিল সামর্থ ছিলনা। মোটরের পুরাতন টিউব কিনে মেরামত করে ব্যবহার করা হতো। তেলের ব্যবহৃত জারকিনও ব্যবহার করা হতো। নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে থাকা কর্মীদের সিঙ্গারা ছাড়া আর কিছু খাওয়ানোর সামর্থ ছিলনা। জাতীয় স্কুল মাদরাসা গ্রীস্মকালীন প্রতিযোগিতায় রংপুর বিজিবির সুইমিং পুলে বিভাগীয় প্রতিযোগিতাটা পরিচালনা করতাম কয়েক বছর ধরে। এই প্রতিযোগিতায় সকল রকমের সহায়তা পাওয়া যেতো। এই প্রতিযোগিতা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের সাঁতারুদের সমস্যাটা চিহ্নিত করা গিয়েছিল। স্কাউট প্রোগ্রামের কাবিংয়ে সাঁতার ১টি গুরুত্বপুর্ন বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এক সময়। কাবের সর্বোচ্য অর্জন শাপলা কাব এওয়ার্ড অর্জনের পুর্বশর্ত ছিল সাঁতার জানতে হবে। এই এওয়ার্ড অর্জনের জন্য মেধার দিক থকে শহরের প্রার্থীরা ভালো হলেও তারা সাঁতার না জানার জন্য এওয়ার্ড পেতোনা আবার গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাঁতার জানলেও মেধার দৌড়ে পারতো না। তখন আমি ঠাকুরগাঁও জেলা স্কাউটস এর কমিশনার। স্কাউট কর্মকর্তা হিসাবে এবং জেলা ক্রীড়া অফিসার হিসাবে এই সমস্যার সমাধানে ঠাকুরগাঁও শহরে ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকটি সাঁতার প্রশিক্ষন পরিচালনা করেছি। ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজ পুকুরে, টি এন্ড টির খালে, সর্বোচ্য সতর্কতা নিয়ে বলাকা উদ্যানে, সালন্দরে অবস্থিত মৎস্য খামারের পুকুরে, জগন্নাথপরের একটি পুকুরে, এবং বিজিবির পুকুরে। সুখের কথা এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশই শাপলা কাব ্এওয়ার্ড পেয়েছে। যারা এওয়ার্ড পায়নি তারা জীবনে বাঁচার জন্য সাঁতার শিখেছে। সাঁতার একবার শিখলে কেউ ভুলে যায়না। তিক্ত অভিজ্ঞতাও কম নাই। তখন আমি পঞ্চগড়ে কর্মরত। পঞ্চগড়ের বৈরাতী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছেলেরা জাতীয় স্কুল সাঁতারের জেলা পর্যায়ে ২২/২৩ টি পুরস্কার নিয়ে যায়। রংপুর বিভাগীয় পর্যায় থেকেও পুরস্কার আনে। তাদের সমস্যা হলো টার্নিং ওয়াল না থাকার জন্য তারা ভালো করতে পারেনা। বিষয়টা অনুধাবন করে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করলাম। এমপি সাহেব একদিন জেলা কর্মকর্তাদের সাথে মত বিনিময় সভায় আমাদের ডাকলেন। সেই মিটিংয়ে আমি প্রস্তাব করেছিলাম বৈরাতী স্কুলের ছেলেরা তাদের একটা পুকুরে সাঁতার কাটে, ট্রেনিং করে। এই পুকুরে ২ পাশে ৮/১০ ফুট লম্বা ২টি ওয়াল করে ভৎসনা করতেই প্রায় ৪০ মিনিট ব্যয় করলেন। পরের এমপি সাহেব গুরুত্ব বুঝে টিআর এর বরাদ্দ দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তবে তা শেষ হয়নি। ঠাকুরগাঁয়ে পীরগঞ্জের একটা স্কুলে আছে ওদেরও একই সমস্যা। টানির্ং ওয়াল থাকলেই ওরা ভালো করবে। কিন্তু তা করবে কে? ঠাকুরগাঁওয়ে এই আয়োজনের সতর্কতার অভাবে দুর্ঘটনায় ১টি ভালো উদ্যোগের অপমৃত্যু ঘটলো এটাই স্বাভাবিক। অথচ এসব বিষয়ে অভিজ্ঞজনদের পরামর্শ বা সহায়তা নিলে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অপুরনীয় ক্ষতিটা হতোনা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *