ePaper

রাজস্ব ঘাটতি না কমলেও শুল্কছাড়ে উদার সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের সাময়িক স্থবিরতা নেমেছিল। ব্যাহত হয়েছিল রাজস্ব আহরণ। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি এলেও রাজস্ব আদায়ের ঘাটতিতে লাগাম টানতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। লক্ষ্যপূরণে একের পর এক ব্যর্থতার খবরেও উল্টো শুল্কছাড় দিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। যা আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ে ভরাডুবির মধ্যেও শুল্কছাড়ে সরকারের ‘উদারতা’ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থসংকট আরও তীব্রতর করে তুলছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতিতে পড়েছে সরকার। অর্জিত হয়নি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও। অর্থবছরের শেষ দুই মাস মে ও জুনে এনবিআরের আন্দোলনে অস্থিরতা আরও বাড়ে। সাধারণত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রাজস্ব আদায় বাড়লেও এবার এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রভাবে সেটি হয়নি। কাস্টমস ও ভ্যাট খাতে জুনের আহরণের চিত্রই সেটি স্পষ্ট করে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের সংশোধিত মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আহরণ হয়েছে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর আগের অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে মোট লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি রয়ে গেছে ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রের কোষাগার যখন হালকা হচ্ছে, তখন শুল্কছাড়ে সরকারের এই উদারতা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এর আগেই শুল্কছাড়ে লাগাম টানার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে বাস্তবে হয়েছে উল্টো। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের সংশোধিত মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আহরণ হয়েছে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা এনবিআরের তথ্য বলছে, মোবাইল ফোন, পোলট্রিশিল্প, ফ্রিজ-এসি, ভোজ্যতেল, টেক্সটাইল, বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুল্কছাড়ের সুযোগ নিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসব খাতে ৩৬ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা করছাড় দেওয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৫ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।
শুল্কছাড়েও কমেনি দাম: গত অর্থবছরে মোবাইল ফোন উৎপাদনে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে দুই হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। সরকারের যুক্তি ছিল, এতে কম দামে মোবাইল ফোন মিলবে। বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। একই ভাবে পোলট্রিশিল্পে ছাড় দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, অথচ বাজারে ডিম-মুরগির দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার যত ছাড় দেবে, বাজারে সিন্ডিকেট ততই শক্তিশালী হবে। করপোরেটরা একদিকে ছাড় নেয়, অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ছোট খামারিরা টিকে থাকতে পারছে না।’ বিদায়ী অর্থবছরে ফ্রিজ ও এসি উৎপাদনের উপকরণে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে ৭১৪ কোটি টাকা। কিন্তু দামে মেলেনি কোনো সুবিধা। দাম বরং বেড়েছে। মিনিস্টার ফ্রিজের প্রকৌশলী মনিরুল হাসান বলেন, ‘সব উপকরণে ছাড় নেই। আবার ভ্যাট বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে দামও বেড়েছে।’ জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের জাগো নিউজকে বলেন, ‘এত ছাড়ের পরও ভোক্তা এর সুফল পায় না। কারণ, কোথাও তদারকি নেই। শুল্কছাড়ের সুফল নিয়ে যায় বড় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল ভোক্তাদের।’ ‘সরকারের এই শুল্কছাড়ের ফায়দা কারা কীভাবে নেয় তা যথাযথভাবে মনিটরিং করা উচিত। এনবিআরে যে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ প্রচলিত আছে সে কারণে বিভিন্ন গ্রুপকে এ সুবিধা দেওয়া হয় কি না-তাও খতিয়ে দেখা উচিত’- যোগ করেন তিনি।
কোথায় কত ছাড়: এনবিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানিতে ২ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা, টেক্সটাইল খাতে ১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) খাতে ৯০৫ কোটি টাকা, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি খাতে ৪৪৭ কোটি টাকা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র খাতে ২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা, ত্রাণসামগ্রী খাতে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, শিল্প কাঁচামাল খাতে ২ হাজার ২৮ কোটি টাকা, মূলধনী যন্ত্রপাতি খাতে ৮ হাজার ৩৩ কোটি টাকা এবং প্রজ্ঞাপন ও অন্যান্য সুবিধা খাতে প্রায় ৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা করছাড় দেওয়া হয়েছে।
করছাড়ে জিডিপির ক্ষতি: এনবিআরের এক অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় দেখা গেছে, করছাড় ও স্বল্প করহার জিডিপির সঙ্গে রাজস্বের অনুপাত ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ এখনো রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতে দুই অঙ্কে যেতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, অব্যাহত করছাড়ের কারণে সরকারকে বিপুল ঋণ নিতে হয়েছে। অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) রাজস্ব বাড়ানোর শর্তে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে। শর্তগুলোর একটি ছিল করছাড় কমানো। বাস্তবে সরকার কিছু খাতে চেষ্টা করলেও সামগ্রিকভাবে করছাড় তো কমেইনি, উল্টো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘করছাড় পুরোপুরি তুলে দেওয়া যাবে না। তবে যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগে করছাড় কমানো অত্যন্ত জরুরি।’ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলছেন, ‘অবশ্যই কিছু খাতে করছাড় দরকার। কারণ, এর সঙ্গে শিল্প ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো বিষয়গুলো জড়িত। তবে করছাড়ের প্রভাব বিশ্লেষণও জরুরি।’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘জনস্বার্থে অবশ্যই করছাড় দিতে হয়। তবে সব ছাড়ের সুবিধা ভোক্তারা পাবে—এটি সবসময় হয় না। ব্যবসায়ীরা লাভের বিষয়টাই আগে দেখবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *