আমিনুল হক শাহীন
চট্টগ্রাম বন্দরের শেড ও ইয়ার্ডে বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে আমদানি হওয়া বিপজ্জনক পণ্যে ভরা তিন শতাধিক কনটেইনার। কাস্টমস এগুলো নিলামে তুলতে পারেনি, আবার ধ্বংসও করা হয়নি। এসব কনটেইনারের ভেতরে রয়েছে দাহ্য রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ-যা দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার নজির: ২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুত বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতেও ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৫১ জন, আহত হন দুই শতাধিক। আগুন নেভাতে সময় লেগেছিল চার দিন। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডভর্তি কনটেইনার বিস্ফোরণ এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তার অভাবের কারণে প্রাণহানি বেড়ে গিয়েছিল। এ ঘটনার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ বিপজ্জনক পণ্য সরাতে উদ্যোগী হয়। কিছু কনটেইনার ধ্বংস ও নিলামে বিক্রি করা হলেও জটিলতার কারণে অনেক পণ্য থেকে যায়। বছর বছর নতুন বিপজ্জনক কনটেইনার যোগ হওয়ায় সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে।
বন্দরে একের পর এক দুর্ঘটনা: চট্টগ্রাম বন্দরে ছোটখাটো দুর্ঘটনার নজির নতুন নয়। ২০২২ সালের ১৩ মে বন্দর এলাকায় ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক পণ্যবাহী এক কনটেইনারে আগুন লাগে। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল মিথানলভর্তি ড্রাম বোঝাই করার সময় বিস্ফোরণে চার শ্রমিক আহত হন। একই বছরে নাইট্রিক অ্যাসিডভর্তি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। এসব ঘটনায় প্রমাণিত, বন্দরে রাখা কনটেইনারগুলোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঝুঁকি সবসময় বিদ্যমান।
নতুন করে তেজস্ক্রিয়তার সংকেত: সবশেষ ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট ব্রাজিল থেকে আসা একটি কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়। বন্দরের ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেমে’ স্ক্র্যাপ লোহা ভর্তি ওই কনটেইনারে থোরিয়াম-২৩২, রেডিয়াম-২২৬ ও ইরিডিয়াম-১৯২ আইসোটোপ শনাক্ত হয়। প্রাথমিক পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা খুব বেশি পাওয়া না গেলেও সতর্কতার জন্য কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লোহার টুকরো ও কনটেইনারের দেয়াল ভেদ করে সঠিক মাত্রা মাপা যায় না, তাই বিস্তারিত পরীক্ষার জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিপজ্জনক কনটেইনারের সংখ্যা: চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে তেজস্ক্রিয় পদার্থসমৃদ্ধ কনটেইনার: ১৩টি
রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থসমৃদ্ধ কনটেইনার: প্রায় ৩৫০টি (যার বেশ কিছু ১০-১৫ বছরের পুরোনো)। এসব কনটেইনারে রয়েছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, সালফেট, সালফিউরিক অ্যাসিড, থিনার, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, নাইট্রিক অ্যাসিড, ইথাইল হেক্সানল, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, টেক্সটাইল কাঁচামাল ও রং তৈরির কাঁচামালসহ নানা দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় পদার্থ।
কর্তৃপক্ষের অবস্থান: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন- বন্দরে তেজস্ক্রিয় পদার্থভর্তি ১৩টি ও বিপজ্জনক রাসায়নিকভর্তি ৩৫০টি কনটেইনার আছে। দ্রুত খালাসের জন্য কাস্টমসকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন বলেন-গত ৩০ জুলাই ৪২টি পুরোনো কনটেইনার খালি করা হয়েছে। আরও ৫০টি খালি করা হবে চলতি মাসেই। ধাপে ধাপে খালি করার কাজ চলছে।
অন্যদিকে যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান জানান- তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত হওয়ার পর কনটেইনার খালাস স্থগিত করে আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। পরমাণু শক্তি কমিশনকে জানানো হয়েছে। তাদের গাইডলাইন মেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বিপজ্জনক পণ্যভর্তি কনটেইনার বছরের পর বছর জমে থাকায় বন্দরের নিরাপত্তা এখন বড় ঝুঁকির মুখে। সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি বা বৈরুত বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় ঠেকাতে হলে এসব বিপজ্জনক কনটেইনার দ্রুত অপসারণ বা ধ্বংসে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে জমে আছে বিপজ্জনক তিন শতাধিক কনটেইনার
