ePaper

কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘরের ঐতিহ্য

শেখ ইলিয়াস মিথুন, মাগুরা

একসময় গ্রামবাংলার প্রতিটি জনপদে চোখে পড়ত মাটির ঘর। নিচে কাদামাটি দিয়ে গড়া মোটা দেয়াল, উপরে ছনের ছাউনিÑকোনো ঝলমলে সাজসজ্জা না থাকলেও এর ভেতরে ছিল অদ্ভুত স্বস্তি। গরমে শীতল, শীতে উষ্ণÑঠিক যেন প্রকৃতির দেওয়া প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশন। তাই তো মানুষ একে ডাকত ‘গরীবের এসি ঘর’। কিন্তু কালের প্রবাহে সেই পরিচিত দৃশ্য আজ বিরল। মাগুরার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, মাটির ঘরের বদলে উঠেছে ইট-সিমেন্টের দালান। যেখানে একসময় সারি সারি মাটির ঘর ছিল, আজ সেখানে ঝলমলে আধুনিক বাড়িঘর। যে দু-একটি মাটির ঘর টিকে আছে, সেগুলোও ব্যবহৃত হচ্ছে কাঠ বা গবাদি পশু রাখার কাজে। মহম্মদপুর উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের রবিউজ ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ছোটবেলায় দেখেছি, প্রতিটি বাড়িতেই মাটির ঘর। গরমকালে ভেতরে ঢুকলে ঠান্ডা লাগত, যেন এসি চলছে।” শ্রীপুরের আমতৈল গ্রামের মশিউর রহমান জানান, “শীতকালে উষ্ণ, গ্রীষ্মে ঠান্ডাÑমাটির ঘরের আরামই আলাদা ছিল। তবে ঝড়-বৃষ্টি আসলেই ভেঙে পড়ত ছাউনি।” শালিখার শিক্ষাবিদ স্বপন বিশ্বাসের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্য। তার ভাষায়, “গ্রামের সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা শান্তির নীড় মাটির ঘর আজ শুধু স্মৃতিতে বেঁচে আছে।” ইতিহাস বলছে, মাটির ঘরের প্রচলন বহু পুরনো। আঠালো মাটি দিয়ে মোটা দেয়াল গড়ে তার ওপর কাঠ-বাঁশের সিলিং বসানো হতো। ছাউনি দেওয়া হতো খড়, টালি কিংবা টিনে। এমনকি দোতালা মাটির ঘরও বানানো হতো একসময়। তিন থেকে চার মাস ধরে কারিগররা ঘর নির্মাণ করতেন। আর ঘরের দেয়ালে গৃহিণিদের আঁকা আলপনা এটিকে দিত ভিন্ন এক সৌন্দর্য। জেলার প্রতিটি উপজেলায় একসময় অসংখ্য মাটির ঘর দেখা যেত। মধ্যবিত্ত ও অসচ্ছল পরিবার যেমন এটি ব্যবহার করত আশ্রয়ের জন্য, তেমনি সচ্ছল পরিবারও বৈঠকখানা ঘর হিসেবে মাটির ঘরকে বেছে নিত। কিন্তু সময়ের স্রোত বদলেছে। বিদ্যুতের আলো পৌঁছেছে গ্রামে গ্রামে, বেড়েছে মানুষের আয় ও রুচিবোধ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, পারিবারিক নিরাপত্তা আর স্থায়িত্বের খোঁজে মানুষ আজ ঝুঁকছে ইট-পাথরের অট্টালিকার দিকে। মাটির ঘরের শীতলতা, শান্তি ও ঐতিহ্য আজ বিলীন হতে বসেছে। প্রজন্মের কাছে রয়ে গেছে শুধু গল্পে, স্মৃতিচারণে আর কিছু ভাঙাচোরা নিদর্শনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *