রিজু সরকার, বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, আলোকচিত্র হচ্ছে সময়ের দর্পণ। এমনকি ইতিহাসের সাক্ষী। একটি ছবির অনেক ক্ষমতা। কিছু না বলেও একটা ছবি দিয়ে অনেক সত্যিকে তুলে ধরা যায়। ফটোগ্রাফি হলো এমন একটি বড় উদ্ভাবন যা বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। আলোকচিত্রের মাধ্যমে সব সময় গর পেছনের গল্পটি উঠে আসে। ক্যামেরার লেন্সের একটি ক্লিকের ছবি যেমন বুকের ভেতর হাকাকার জাগিয়ে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও জোগায়। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত রূপসী বাংলা জাতীয় আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম মহসিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ। আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ, লেখক ও গবেষক ওবেইদ জায়গীরদার, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল তালুকদার, নাসিম শিকদার প্রমুখ। কাদের গনি চৌধুরী বলেন, একটি ছবি একটি গল্প বলতে পারে এবং আবেগ, মেজাজ ও বার্তা প্রকাশ করতে পারে – এমনকি এমন ধারণাও জাগাতে পারে, যা শব্দ পারে না। ‘আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বরের একটি ছবি বিশ্ববিবেককে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ছবিটি কী ছিল? ভূমধ্যসাগরের তীরে মুখ লুটিয়ে আছে তিন বছরের এক শিশু, আয়লান। নিষ্পাপ আয়লানের নিথর দেহের ছবি কাঁদিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। বলেছিল যুদ্ধের নির্মমতা, অমানবিকতা। তুরস্কের উপকূলে নিথর পড়ে থাকা তিন বছরের শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দি নাম শুনলে এখনো স্তব্ধ হয়ে যান অনেকে।’কাদের গনি চৌধুরী বলেন, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে আয়লানের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তার মা ও আয়লানের ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে তুরস্কে যান। তুরস্ক থেকে নৌকায় করে গ্রিসের উদ্দেশে রওনা হন। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ছোট নৌকায় থাকা আয়লান ও তার ভাই ভেসে যায় তুরস্কের সৈকতে। তাদের মা ভেসে যান দূরের অন্য এক সৈকতে। নৌকাটি ডুবে যাওয়ার আগে আবদুল্লাহ কুর্দি তার স্ত্রী, কন্যা ও আয়লানকে ঢেউয়ের কবল থেকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। তবে একে একে সবাইকে ডুবে যেতে দেখা ছাড়া হয়তো তার কিছুই করার ছিল না। যখন ঢেউয়ের কবলে নৌকাটির সামনের দিক উঁচু হয়ে যাচ্ছিল, তখন আয়লানের বাবার দুই বাহুতে তার দুই সন্তান। এরই মধ্যে বড় ঢেউ মেয়েকে ছিনিয়ে নেয়। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বাবা আয়লানকে পানির ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন। আর তখন আয়লান চিৎকার করে বলেছিলো, ‘বাবা, প্লিজ তুমি মরে যেও না।’ এই কথা বলতে বলতেই সমুদ্রের ঢেউ ছোবল মেরে নিয়ে যায় আয়লানকেও। ‘কালো হাফ প্যান্ট আর লাল শার্ট পরা শিশুটির মৃতদেহ পরিণত হয় যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার লাখো শরণার্থীর প্রতীকে। একটি ছবিই বলে দিয়েছিল শত সহস্র নিরুপায় শরণার্থীর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনি। ক্যামেরাম্যান আয়লানের ছবিটি না তুললে এই ঘটনাটি দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন তৈরি করতো না।’আরেকটি ঐতিহাসিক ছবির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালের মার্চের কোনো একদিন। গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষে পীড়িত দক্ষিণ সুদান। ক্ষুধার জ্বালায় হামাগুড়ি দিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কেন্দ্রের দিকে এগোচ্ছিল একটি কন্যা শিশু। ছোট্ট দু’পায়ে আর একরত্তিও শক্তি ছিল না যে আরেক কদম এগুবে। সেসময় কানাডীয় আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার দেখেন একটি শকুন অনুসরণ করছে শিশুটিকে। দিনের পর দিন খাবার না পেয়ে কংকালসার ও শক্তিহীন শিশুটি চেষ্টা করছে খাদ্য সহায়তা কেন্দ্রের দিকে যেতে। আর শকুন অপেক্ষা করছে কঙ্কালসার এ শিশুটির প্রাণবায়ু কখন শেষ হবে। তাহলে সে খেতে পারবে। আদিমতম এক লড়াইয়ের ছবি। এদিকে কে জিতবে? শিশু না শকুন? সে ছবির জন্য কার্টার নিজে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ক্ষুধার্ত শিশুর এই অতি অমানবিক ছবি তোলার নৈতিকতা নিয়ে তুমুল সমালোচনা থাকলেও সে সময়ে সুদানের গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা সারা বিশ্বে জানান দিয়েছিল এই ছবি। তিনি বাংলাদেশে ফটোসাংবাদিকদের অবদান তুলে ধরে বলেন, ১৯৭৪ সালে বস্ত্রাভাবে লজ্জা নিবারণের জন্য রংপুরের বাসন্তী ও দুর্গা নামের দুই যুবতী নারীর দেহে মাছ ধরার শতচ্ছিন্ন জাল জড়ানোর ছবি দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তখনকার বাংলাদেশের প্রধানতম সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় এ ছবি ছাপানো হয়েছিল।’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের অনেক ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সেদিন বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করেছিল। বিশেষ করে লঙ্গরখানায় ক্ষুধার্ত মানুষের ঢ্ল, ডাস্টবিনের খাবার নিয়ে কুকুর আর মানুষের টানাটানি ইত্যাদি। আবার এই দুর্ভিক্ষের মধ্যে সোনার মুকুট পড়ে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বিয়ের ছবি দৈনিক বাংলায় ছাপার পর দেশজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। তিনি বলেন, সীমান্তে কাঁটা তারে ফেলানির ঝুলে থাকা লাশের ছবি ভারতীয় আগ্রাসন সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিল। এই যে কয়েকটি ছবির কাহিনী বললাম, এতে এটিই প্রমাণিত হয় যে, একটি আলোকচিত্র জীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারে, মানুষের প্রতিরোধ, প্রতিবাদ কিংবা মানবিকতার ভাষা হয়ে উঠতে পারে। একটি ছবির অভিঘাত সমাজ ও জীবনের অনেক কিছুই পাল্টে দিতে পারে।
