নিজস্ব প্রতিবেদক
পাবনার ঈশ্বরদীতে প্রায় ২৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে শিমের আবাদ করা হয়। এই আবাদে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন নারী শ্রমিক ও কৃষক পরিবারের নারী সদস্যরা। চাষিরা বলেছেন, শিম আবাদে ৭০ ভাগ অবদান নারীদের। কৃষি কর্মকর্তারাও শিমচাষে নারীদের অবদানের বিষয়টি তুলে ধরছেন। শিমচাষিরা জানান, শিমচাষ লাভবান হলেও এটি আবাদ ব্যয়বহুল ও শ্রমসাপেক্ষ। সঠিক পরিচর্যা না করলে ফলন ভালো হয় না। আর এ পরিচর্যার কাজটি করে থাকেন নারী চাষি বা নারী শ্রমিকরা। এই উপজেলায় কয়েক হাজার নারী শ্রমিকের শিম মৌসুমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পুরুষ চাষিরা শিমের চারা বপনের বেড (বিটি) তৈরি, চারা রোপণ, সার ও কীটনাশক স্প্রের কাজ করেন। তাছাড়া বাকি প্রায় সব কাজই নারী শ্রমিকরা করে থাকেন। শিমের বীজ বপনের দিন থেকে শুরু হয় পরিচর্যার কাজ। এরপর সেচ দেওয়া, চারা পরিচর্যা, পাঠকাঠি ও ধনজা দিয়ে জাংলা তৈরি, শিম গাছ পরিচর্যা, শিমের লতার প্যাঁচ ছাড়ানো, মরা পাতা বাছাই করা, গাছ থেকে নষ্ট ফুল বেছে ফেলে দেওয়া, ক্ষেত থেকে শিম সংগ্রহ, এমনকি শিম বাজারজাতকরণেও নারীরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন।মুলাডুলির শেখ পাড়ার নারী শিম চাষি আবিদা পারভীন বলেন, শিম এখন আমাদের এলাকার প্রধান ফসল। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে আগাম শিমের আবাদ শুরু হয় এবং চৈত্র মাস পর্যন্ত এ ফসল থাকে। বছরের ৮-৯ মাস শিম চাষে আমাদের সময় কেটে যায়। এক বিঘা জমিতে শিম চাষে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হলেও ফলন ভালো হলে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। এবছর শিমের দাম ভালো থাকায় চাষিরা বেশ লাভবান হয়েছেন। আমার একবিঘা জমিতে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার শিম বিক্রি হয়েছে। তিনি বলেন, শিম চাষে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি পরিশ্রম করে। পুরুষ চাষিরা শুধুমাত্র শিম গাছের বিটি ও বীজ বপন করে দেয়। বাকি সব কাজ এখন নারীরা করতে পারে। সেচ ও পরিচর্যাসহ সব কাজ নারীরা করে। ফসল সংগ্রহ করে এখন আর বাজারে নিয়ে যেতেও হয় না। পাইকাররা জমি থেকে শিম কিনে নিয়ে যায়। আবার নির্দিষ্ট কিছু ভ্যানচালক রয়েছে, তাদের মাধ্যমে শিম আড়তে পাঠানো হয়। মোবাইল ফোনে আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করি। শিম খুব যত্নশীল ফসল। সূক্ষ্মভাবে নারী চাষি ও নারী শ্রমিকরা অত্যন্ত যত্নসহকারে শিমের আবাদ করছেন।নারী শ্রমিক সেলিনা খাতুন বলেন, শিম বাগানে কাজ করে প্রতিদিন ৩০০ টাকা হাজিরা পাই। এই টাকা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার খরচ যোগানোর পাশাপাশি একটি ছাগল কেনার চেষ্টা করি। তাছাড়া সংসারের পেছনেও খরচ করি। শিম আবাদে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ থাকায় পরিবারকে আর্থিকভাবে মোটামুটি ভালো সহযোগিতা করতে পারি। মুলাডুলি ঝাঝরপাড়া এলাকার শিমচাষি মিলন হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, শিমচাষে পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে নারী শ্রমিকদের বেশি কাজ। পুরুষ শ্রমিক দিয়ে শুধু শিমের বীজ বপনে বিটি (বিট) তৈরি ও জাংলা দেওয়ার কাজ করি। শিমের পরিচর্যায় লতা বাছাই, ফুল বাছাই, শিম সংগ্রহ, সেচ দেওয়াসহ যাবতীয় কাজ নারী শ্রমিকরা করে থাকে। এবার শিম চাষে বিঘা প্রতি এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। আরও দেড়-দুই মাস এ শিম বিক্রি করা যাবে।মুলাডুলি ইউনিয়নের কৃষি উপসহকারী রুমানা পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, শিম চাষে নারী শ্রমিকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পুরুষরা বীজ বপন, কীটনাশক ও জাংলা দেওয়া ছাড়া সব কাজ নারী শ্রমিকরা কাজ করেন। নারী শ্রমিকদের কম মজুরির কারণে শিম চাষিরা তাদের বেশি এ কাজে ব্যবহার করে।একজন নারী শ্রমিক সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করলে ৩০০ টাকা মজুরি দেয়। এ কাজ পুরুষ শ্রমিকরা করলে তাদের মজুরি দিতে হতো ৬০০-৭০০ টাকা। তাই শিম চাষিরা এ কাজে নারী শ্রমিকদের বেশি ব্যবহার করেন। এতে কৃষকরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি নারীদের বাড়তি আয় হচ্ছে। এসব নারী শ্রমিকরা অধিকাংশই গৃহিণী ও ছাত্রী।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ঈশ্বরদী আগাম শিম চাষের জন্য বিখ্যাত। এবার প্রায় ১৪০০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। শিম চাষের সঙ্গে নারী শ্রমিকরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তারা শিম চাষের শুরু পর্যায় থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে কাজ করেন। দিন যত যাচ্ছে তাতে কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা বাড়ছে এটি আশাব্যাঞ্জক।