
জানুয়ারির মাঝামাঝি অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলেন নীলফামারীর জলঢাকার সোহাগ হোসেন। চিকিৎসকরা জানান, রোগীর হার্টে দ্রুত রিং পরাতে হবে। এনজিওগ্রামসহ এক লাখ টাকার মতো খরচ পড়বে। পেশায় কৃষক সোহাগ প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পেরে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। তিনি জানালেন, ‘টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তবে ১ লাখ ৮ হাজার টাকার রিং এখন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হয়েছে বলে তিনি শুনছেন। টাকা জোগাড় না হওয়ায় ঢাকায় যেতে পারছি না। এদিকে স্ত্রীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে।’
ডলার সংকট ও ডলারের বাড়তি দাম নিয়ে দেশে বেশ কিছুদিন ধরেই অস্থিরতা চলছে। এর অজুহাতে প্রায় সবধরণের পণ্যের দামই বৃদ্ধি পেয়েছে। যারসঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জামের মূল্য। জানা যায়, পাঁচ মাস ধরে এলসি (ঋণপত্র খোলা) জটিলতায় হৃদরোগসহ অন্যসব চিকিৎসায় ব্যবহৃত আমদানিনির্ভর সার্জিক্যাল ডিভাইস সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়লে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও এলসি খোলার ক্ষেত্রে সহায়তা পেতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ইতোমধ্যে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির দাম শতকরা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির অনুমোদন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এলসি খোলার কাজ সম্পন্ন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন অধ্যাপক রবিউল ইসলাম ও গোলাম কবির রংপুর ল্যাবএইড চেম্বারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষ পকেট থেকে অর্থব্যয়ে বাধ্য হচ্ছেন। এতে প্রতিবছর মানুষ সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়ছে, যা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পরিপন্থি। বস্তুত জীবনরক্ষাকারী রিং, পেসমেকারসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্যবৃদ্ধিতে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির হৃদরোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়ছেন। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারের সামনে তাদের করুন আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। উপরন্তু তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে গেছে, যা মোটেই কাম্য নয়।’ ডলার ও কাঁচামালের দাম হ্রাস পেলে আমদানিনির্ভর এসব চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্য সমন্বয় করার আশ্বাস দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর পেছনে রয়েছে ১০টি সুনির্দিষ্ট কারণ, যার মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে হৃদরোগ ও স্ট্রোক। এ রোগে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১৫ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ। আশঙ্কাজনক হলো, আমাদের দেশেও মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগ ও স্ট্রোক। আজকাল মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসায় ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড প্রভৃতির প্রভাবে দেশে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রায় ২৭ শতাংশ। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি হাজারে ১০ জন শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ অবস্থায় দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি করে হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি এগুলোর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা গেলে সুচিকিৎসার সম্ভব। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এর মধ্যে চিকিৎসায় বাড়তি ব্যয় মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। তাই মানুষ বাঁচাতে হলে চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম কমানোর বিকল্প নেই। হৃদরোগ চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দাবি বিশ্বমন্দার কারণে প্রতিটি সরঞ্জামের আমদানি খরচ ১৫ থেকে ২৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। যে রিংয়ের দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, সেটি এখন ৮২ হাজার টাকা হয়েছে। একইভাবে ১ লাখ ৮ হাজার টাকার রিং এখন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং দেড় লাখ টাকার রিং ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। ৯৫ হাজার টাকার পেসমেকারের দাম ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করতে না পারায় কয়েক মাস আগে থেকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসাসেবাও ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ইতোমধ্যে কার্ডিয়াক সার্জারির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে হৃদরোগীদের মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন মুঠোফোনে জানান, দেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় একমাত্র বিশেষায়িত ও বেশি ভরসার স্থল এ হাসপাতাল। এখানে প্রতিদিন হার্টের ছোট-বড় অস্ত্রোপচার হয়। রোগীদের ৭০ শতাংশ গরিব। কিন্তু হৃদরোগ চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বাড়ানোয় রোগীদের কষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আগে হার্টের চিকিৎসার সরঞ্জামের দাম বাড়ানো নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন আলোচনা করত। কিন্তু এবার তাদের কিছুই জানানো হয়নি।