ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

কৃষিতে চাঙ্গা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি

কাজের অভাবে এক সময় উত্তরাঞ্চলের মানুষকে অবসর সময় কাটাতে হতো। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময় এখানে মঙ্গা বিরাজ করতো। তবে মঙ্গাকে জয় করেছে উত্তরের কৃষক। নি.সন্দেহে দিনবদলের অংশ হিসেবে উত্তরের কৃষিও বদলে গেছে। কৃষি বলতে এখন আর শুধু ফসল উৎপাদন বোঝায় না। ফসলের উৎপাদনশীলতার উন্নতির পাশাপাশি সবজি, মাছ, মুরগি, গবাদি পশু, ফুল-ফল উৎপাদনে অনেক শিক্ষিত উদ্যমী তরুণ উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছেন। বিদেশে কিছুদিন কাজ করে খানিকটা পুঁজি সংগ্রহ করে অনেক উদ্যমী প্রবাসী এ অঞ্চলে ফিরে এসে মাছের চাষ, মাল্টার বাগান, ড্রাগন ফল, ফুলের চাষ, মুরগি, টার্কি, ছাগল, গরুর খামারসহ নানা উদ্যোগ গড়ে তুলছেন। তাঁদের দেখাদেখি অন্য শিক্ষিত তরুণরাও নতুন করে কৃষিতে ঝুঁকছেন। তাঁদের কারণেই কৃষি আজ উদ্যমী উদ্যোক্তাদের কাছে সবচেয়ে আশা-জাগানিয়া এক ভরসার খাত হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের নয়া কৃষির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এই বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি বাজেটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি খাতে বাড়তি বাজেট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছেন। স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে তিনি গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার লক্ষ্যে যান্ত্রিকীকরণ, পেমেন্ট পদ্ধতি এবং সরবরাহ চ্যানেল ডিজিটাল করার জন্য নানামুখী নীতি-সমর্থন দিয়ে চলেছেন। উত্তরের রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের অধিকাংশ মানুষ কর্মের জন্য ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম মুখি ছিল। এখন বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। কিছু যুবক বদলে দিচ্ছেন নিজের বেকারত্ব, অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন অন্যদের। এমনই একজন যুবক সোহেল আহমেদ। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ধর্মপাল ইউনিয়নের যুবক সোহেল আহমদ বিভিন্ন স্হান থেকে ঋণ নিয়ে শুরু করেন বানিজ্যক ভাবে মাছ চাষ। বর্তমানে তার ৩৭ শতাংশ জমির একটি বিরাট পুকুরসহ আরও ৪ টি পুকুর রয়েছে। এখানে মাছ চাষ করে প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা লাভবান হচ্ছেন তিনি। সোহেল আহমদ বলেন, ‘বানিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ করে আমি লাভবান। এখন পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে আছি। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মাছচাষের খামারকে আরও সম্প্রসারণ করা। শুধু চাকরির আশায় না থেকে এ পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আমাকে দেখে এখন এলাকার যুবকরা মাছ চাষ করে আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করছে।’ একজন উদ্যোক্তা বদলে ফেলছেন একটা উপজেলার চিত্র। এ বিষয়ে কথা বলতে জলঢাকা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা লিসমা হাসান এর কার্যালয়ে যেয়ে কথা হলে তিনি জানান – ‘বানিজ্যিক ভাবে মাছচাষের পুকুরের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এখানকার আবহাওয়া ও মাটি মাছচাষের উপযোগী, যেকারণে এখানে মাছের উৎপাদন হয় ভালো। আমরা মাছচাষীদেরকে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে সকল ধরনের পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি।’ তবে ভুট্টা এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনজীবিকা। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টা গাছ ও সবুজপাতা উন্নতমানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও ভুট্টার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া জ্বালানি হিসেবে ভুট্টার গাছের রয়েছে আলাদা কদর। এক সময় চরাঞ্চলের মানুষ না খেয়ে কষ্টে জীবনযাপন করত। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে চর এলাকার চেহারা বদলে গেছে। বালুচরে ভুট্টা চাষ করে পাল্টে গেছে তাদের জীবন। গ্রামগুলোতে খড়ের ঘরের পরিবর্তে উঠেছে আধাপাকা ঘর। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না তাদের। তিস্তা নদীর বুকে জেগে উঠা একাধিক চর। সেই চরে চলছে নানা জাতের ফসলের চাষাবাদ। ভুট্টা চাষে প্রতি বিঘায় প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় ভুট্টার ফলন আসে ৩৫-৪০ মণ। বাজারে নতুন ভুট্টার মণ ৬০০-৭০০ টাকা। রংপুর জেলার গংগাচড়ায় তিস্তার ছোট-বড় প্রায় ২৩টি জেগে ওঠা চরে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। গতবছর এ উপজেলায় ২৩ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। চলতি বছর ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ আরও প্রায় ছয় হাজার হেক্টর বেড়েছে। প্রতিবছর তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। প্রচলিত কৃষি কাজের বাইরে অর্থাৎ ধান-পাট এসব চাষের বাইরে কৃষির বিভিন্ন উপখাত যেমন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগীর খামার, পশু পালন, দুগ্ধ খামার ছাড়াও বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষ ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর ফলে যেমন বহু বেকারের কর্ম সংস্থান হয়েছে, তেমনি চাঙ্গা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরে অনেক যুবক চাকরি হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে এসে মাছ চাষ, হাস-মুরগীর খামার, নয়তো গরুর খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এর বাইরেও বাণিজ্যিকভাবে সবজি এবং হরেক রকম ফলমূল চাষ করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া গ্রামের মা-বোনরা অনেকে হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ভেড়া পালন, টার্কি পালন, বাড়ির আঙ্গিনায় ফলমূল, শাক-সবজি ইত্যাদি চাষের মাধ্যমে বাড়তি আয় করে অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন। এভাবেই চাঙা হচ্ছে রংপুর বিভাগের অর্থনীতি ।

সংবাদটি শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Tweet about this on Twitter
Twitter
Email this to someone
email
Print this page
Print
Pin on Pinterest
Pinterest

দৈনিক নবচেতনার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন